গণতান্ত্রিক সমাজ বহুবাচনিক আর গণমাধ্যম বহুস্বর, বহুস্মৃতি, বহুস্বপ্ন’র ধারক, জাতির বিবেক। এটি উন্নয়ন-যাত্রায় প্রধান অনুঘটক ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের সাথে গণমাধ্যমের ওতপ্রোত সম্পর্ক। গণমাধ্যমকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা অসম্ভব।
গণমাধ্যম সমাজের সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া সচল রাখে, ক্রান্তিলগ্নে জাতির বিবেক হিসেবে, জনগণের সম্মিলিত কন্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রাখে। গণমাধ্যম ইতিহাস সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক সরকার গণমাধ্যমের সাথে হাত ধরে গণতন্ত্রকে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। গণমাধ্যম একটি নির্দিষ্ট পেশা হলেও এর চালিকা শক্তি একটি আদর্শ। সে জন্য কি সে আদর্শ, সে আদর্শে আপনি কতটুকু উজ্জীবিত, আপনি কতটুকু সে আদর্শ ধারন করছেন-তার ওপর নির্ভর করছে গণতন্ত্রের বিকাশ ও নির্মাণে গণমাধ্যম কতটুকু ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের এ ভূখন্ড দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এ পর্যায়ে আসার পেছনে গণমাধ্যমের উজ্জল ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে, জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও সাংবাদিকদের বলিষ্ঠ ভূমিকা দৃশ্যমান। সুতরাং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের একটি গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে। সে অতীত, গৌরব ও ঐতিহ্য ধারণ করে সামনে আরো গৌরবময় অধ্যায় রচনা করার জন্য আগামীর পথে এগুতে হবে গণমাধ্যমকর্মীদের। তাদের ভূল করার অধিকার নেই। অতন্ত্র প্রহরীর মতো জেগে থাকতে হয়। এ জন্যই সে গণতন্ত্রের আয়না। সে আয়নায় সমাজের ও গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। সে প্রতিচ্ছবি এ আয়নায় স্বচ্ছভাবে ধারণ করতে গণমাধ্যমের পবিত্রতা, স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা আবশ্যক। এমন কোন কাজ রাষ্ট্র করতে পারে না, এমন কোন কাজ গণমাধ্যমকর্মীরা করতে পারে না যাতে এই গণসমাজের এই দর্পণ ঝাঁপসা হয়ে যায় এবং সমাজের চিত্র ফুটে না উঠে।
আজকের যুগের বাজার শক্তির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরছে গণমাধ্যম। ধার্মিকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে তা সাধারণ জনগণকে বোঝানোর দায়িত্বও গণমাধ্যমের কাঁধে। ধার্মিকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার মাঝখানে যে রেখাটি সেটি এতই সূক্ষ যে, কখনও একজন মানুষ ধার্মিকতার চর্চা করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে আবার কখনও সে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ধর্মের ওপরেও আগ্রাসন করছে। এটির বিচার-বিশ্লেষণ করার দায়িত্বও গণমাধ্যমকর্মীর।
আমরা যারা তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন তথ্য কিন্তু পণ্য নয়। তথ্যের একটি সামাজিক মাত্রা আছে। আর সে জন্য গণমাধ্যমের একটি দায়বদ্ধতা আছে। সে দায়বদ্ধতা সমাজের প্রতি, একটি নারী ও শিশুর নিরাপত্তার প্রতি, ভূখন্ডের এবং ইতিহাসের প্রতি, মানবমুক্তির আদর্শের প্রতি, সে দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের জন্যে, মুক্তিযুদ্ধের জন্যে। এই দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করলে, গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে ভূমিকা না রাখলে, গণমাধ্যম সমাজের দর্পন হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইন দিয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, করা সম্ববও নয়। চেতনা দিয়ে, বিবেক দিয়ে এ দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েই সাংবাদিকদের পেশায় কর্মরত থাকতে হয়। তথ্য হচ্ছে শক্তি। এ শক্তি যেটুকু অর্জন করা যায় সেটুকুই সমাজকে শক্তিশালী করে। এ জন্য অবাধ তথ্য প্রবাহের নিমিত্ত সরকার তথ্য অধিকার আইন ও তথ্য কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু এখনো সে আইনটি কাজে লাগানোর দক্ষতা আমরা অর্জন করতে পারিনি। আশা করছি গণমাধ্যমের কর্মীরা জনগণের পক্ষে আইনটি কাজে লাগিয়ে সমাজে আলো ফেলার চেষ্টা করবেন।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের নিবন্ধন শাখা থেকে সংবাদপত্রের নিবন্ধন প্রদান করা হয়। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর প্রকাশিত ৩০শে জুন ২০২৩ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩২২৭টি (অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভূক্ত নয়)। এর মধ্যে ১৩৪১টি ঢাকা থেকে এবং ১৮৮৬টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দৈনিক ১৩১১টি, অর্ধ-সাপ্তাহিক ৩টি, সাপ্তাহিক ১২১০টি, পাক্ষিক ২১৫টি, মাসিক ৪৪১টি, দ্বি-মাসিক ৯টি, ত্রৈ-মাসিক ৩৩টি, চর্তুমাসিক ১টি, ষান্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক ২টি পত্রিকা রয়েছে। ২০০০ এর অধিক অনলাইন পত্রিকা রয়েছে। নিবন্ধনকৃত অনলাইন পোর্টাল (টিভিসহ) ১৭০টি। মিডিয়াভূক্ত পত্রিকা ৭০৫টি। দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেল আছে ৩৯টি। বিদেশি ১২১টি। কমিউনিটি রেডিও ১৫টি এফএম রেডিও ১৩টি। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের সকল গণমাধ্যমের জেলা প্রতিনিধি রয়েছে। বলা চলে বাংলাদেশে এখন গণমাধ্যমের জয়জয়কার।
গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে সম্পর্ক ১৯৯৯ সাল থেকে। দীর্ঘ ২৪ বছরের পরিক্রমায় গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান। সংবাদ পরিবেশন, সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ-সব কিছুতেই এ পরিবর্তনের বাতাস লেগেছে। ৯০ এর দশকে তিন-চারটি টেলিভিশন চ্যানেল, সপ্তাহে দু-চারটি নাটক, এক-দুটি সিনেমা, দিনে দু-চার বার সংবাদ পরিবেশন হতো। এখনকার অবস্থা বলা বাহুল্য।
সবার আগে বর্তমানে গণমাধ্যম মালিকানায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। করপোরেট হাউজগুলোর অধিকাংশই এক বা একাধিক গণমাধ্যম এর মালিক। ইতিবাচক নেতিবাচক-দুটি দিকই এতে ফুটে উঠছে। কোন কোন করপোরেট হাউজ সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের বাইরে এসে নিজেদের ব্যবসার পরিস্ফুটনে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। হাতে গোনা কয়েকজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক নিয়ে তাদের গণমাধ্যম যাত্রা করে। কিছু উঁচু বেতন অফার করে বিভিন্ন হাউজ থেকে কিছু সাংবাদিক বাগিয়ে আনে। সাথে থাকে কিছু অপেশাদার কর্মীও। যেই না হাউজটি কিছু পরিচিতি লাভ করে, শুরু হয় কর্মী ছাঁটাই, রাজপথে আন্দোলন, কলম বিরতি, বক্তৃতা-বিবৃতি। আমার ব্যক্তিগত মত সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আনতে, বেতন ও চাকরির নিরাপত্তা পেতে হাউজ বাছাইয়ে সতর্কতা আনতে হবে।
দীর্ঘ ১৮ বছর জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি কিছু গণমাধ্যমকর্মী এতো ঘনঘন হাউজ পাল্টাচ্ছেন যে, বর্তমানে তিনি কোন্ হাউজে আছেন প্রায়ই জেনে নিতে হয়। আবার কাউকে কাউকে দীর্ঘদিন একই হাউজে কাজ করতে দেখেছি। হাউজ পাল্টানোর কারণের মধ্যে রয়েছে মানসম্মত সাংবাদিকতা করতে না পারা, লেখাপড়ার কমতি বা অমনযোগিতা, পেশাদারিত্বের অভাব, বেশি বেতনের উঁচু আকাঙ্খা ইত্যাদি।
বর্তমানে একেকটি গণমাধ্যম একেকটি শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের যে শ্লোগান সেটা বুকে ধারণ করতে দেখা যায় না।
এখানে একটা বিষয় নজরে এসেছে, ঢাকার কিছু সিনিয়র রিপোর্টারের একটি করে ‘ছোট’ পত্রিকা রয়েছে। কখনো জানা যায়, কখনো যায় না। তিনি একাধারে একটি বড় পত্রিকার রিপোর্টার আবার একটি ছোট পত্রিকার প্রকাশক। উদ্দেশ্য অজ্ঞাত। আবার কেউ কেউ বড় হাউজে জায়গা না পেয়ে নিজেই একটা মিডিয়া খুলে নেন।
সাংবাদিকতায় আগে প্রচ্ছন্ন রাজনীতি ছিল। এখন সাংবাদিকতায় রাজনীতি বেশ সামনে এসে পড়েছে। সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অমুক ভাইয়ের তমুক ভাইয়ের পক্ষে কিছু সাংবাদিক এখন প্রকাশ্যেই বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। আবার বহুল আলোচিত ‘টক শো’ তে কিছু সাংবাদিকের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়।
সাংবাদিকতায় একটা ইতিবাচক বড় পরিবর্তন হলো ‘বিট সাংবাদিকতা’। পূর্বে একই ব্যক্তি সকল বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। এখন এখানে পরিবর্তন এসেছে, পেশাদারিত্ব তৈরি হয়েছে। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ে বিট তৈরিতে আমার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু এখানে মফস্বল সাংবাদিকতা অনেক পিছিয়ে আছে। একই ব্যক্তিকে সব ধরণের সংবাদ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সে অনুযায়ী তার প্রশিক্ষণ নেই, বেতন নেই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষাও নেই, সাংবাদিকতার জ্ঞান ও মূল্যবোধও নেই।
সংবাদ সংগ্রহের ধরণে পরিবর্তনটা আরো বেশি দৃশ্যমান। আগে একটি অনুষ্ঠান লাইভ হবে-এটা ভাবতেই অন্যরকম লাগতো। এখন অনেক অনুষ্ঠানই লাইভ হয়-গ্রাম থেকেও। খুব বড় কিছু না হলে মন্ত্রীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হতো না। এখন প্রায় সব অনুষ্ঠানেই মন্ত্রীদের বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তারা কোন বিষয়ে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিবেন-এটা অনেকটা অকল্পণীয় ছিল। এখন উপজেলা কর্মকর্তারাও সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।
তবে দৃষ্টিকটু অংশও আছে। কিছু কিছু প্রেস ব্রিফে কেউ কেউ এমন সব প্রশ্নও করে বসেন যে, যেটা বিষয় বা অনুষ্ঠানের সাথে যায় না। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এখন যারা সিনিয়র ২০ বছর আগে তারা রিপোর্টার ছিলেন। প্রেস ব্রিফ এমনিতেই খুব বড় বা স্পর্শকাতর বিষয় না হলে করা হতো না। করা হলেও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বেশ লেখাপড়া করে, প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে অংশগ্রহণ করতেন। এখন তেমনটি খুব একটা দেখা যায় না। তারা মন্ত্রী-সচিবকে নিজ থেকে তেমন প্রশ্ন করতেন না। কারণ এটা ব্রিফিং। ব্রিফ দাতা যতটুকু বলবেন বা জানাবেন ততটুকুর জন্যই ব্রিফিং ডেকেছেন, তার অতিরিক্ত নয়, অবাঞ্চিত বা অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের জন্য নয়। তবে খুব প্রাসঙ্গিক বা বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কোন তথ্য বাদ পড়লে তারা খুব সৌজন্যের সাথে সেটার ইঙ্গিত দিতেন, প্রশ্ন করতেন না। হয়তো ব্রিফিং শেষে তার উত্তর দেওয়া হতো। এখন অনেক গণমাধ্যমকর্মী ব্রিফকে ছাপিয়ে নিজের প্রশ্নটাকে বা প্রশ্ন করাকে সামনে নিয়ে আসেন। আরো মজার বিষয় হলো প্রেস ব্রিফিংয়ে কিছু গণমাধ্যমকর্মী নিজের উপস্থিতি প্রমান করতে উঠে দাঁড়ান। ব্রিফদাতার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন, বিষয়ের বাইরে অনেক কথা বলেন। হাস্যরসেরও সৃষ্টি হয়।
আবার কিছু সময় দেখা যায় হয়তো একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে। মন্ত্রী হাজির হয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে সে বিষয়ে না থেকে সাংবাদিকরা অন্য একটি বিষয়ে মন্ত্রীকে বুম ধরেছেন। নিউজ কভারও হয় সেই অন্য বিষয়ের। মূল অনুষ্ঠান আড়ালে পড়ে যায়। এমনও দেখেছি একটি অনুষ্ঠানে হয়তো অনেক মন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন, কথা বলেছেন। কেউ কেউ তার ‘পছন্দের ভাইয়ের’ বাইটটাই প্রচার করছেন। অন্য ভাইরাও যে সে অনুষ্ঠানে ছিলেন পরিবেশিত সংবাদ দেখে তা বুঝাও যায় না।
লাইভ টকশো বা টকশোর সাথে শ্রোতার প্রশ্ন এটিএন বাংলা প্রথম শুরু করে। সে অনুষ্ঠানে প্রথম দিকে কোন মন্ত্রী-সচিব যেতে দ্বিধা করতেন। কি জানি কি বিব্রতকর প্রশ্ন এসে পড়ে। এখন টেলিভিশনে টকশো মুড়ি-মুড়কির মত। বিষয়ে-অবিষয়ে কত টকশো হয় কেউ বলতে পারে না।
সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ এখন বেশ বেড়েছে। এটা আশাব্যঞ্জক। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নেতৃত্ব তৈরিকরণ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারীর পক্ষে কথা বলা ইত্যাদিতে নারী গণমাধ্যমকর্মী সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। ক্যামেরা পারসন হিসেবেও আজকাল নারীরা এগিয়ে আসছেন।
বলা হয়ে থাকে সাংবাদিক মানে সাংঘাতিক। এটা মনে হয় সাংবাদিকতার নেতিবাচক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। অনেক সাংবাদিক এ বাক্য স্বীকার করে নেন। কারণ কি? সোজা কথায় অপসাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার যে ইথিক্স, নর্ম বা পেশাদারিত্ব, তার বাইরে গিয়ে অনেকে অকাজ করে এই খ্যাতি অর্জন করেছেন। সাংবাদিকতার যে আয়নার কথা বলা হয়েছে সেখানে ঝাঁপসাটে কাম্য নয়।
এখন ডেভেলপমেন্ট স্টোরি বেশ হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে বেশ প্রচার হচ্ছে। ক্রাইম নিউজ হচ্ছে। তবে ক্রাইম এর উপর অনুসন্ধানী নিউজ মনে হয় কম হচ্ছে, ফলোআপ নিউজ কম হচ্ছে।
সাংবাদিকতার কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলা পর্যন্ত পত্রিকার প্রকাশনা চলে গেছে। অনলাইন গণমাধ্যম বর্তমানে কয়টি, কেউ বলতে পারবে না। অনেকেই তাই প্রশ্ন তুলেছেন একটি জেলায় কয়টি পত্রিকা থাকলে মানসম্মত সংবাদপ্রাপ্তি সম্ভব। কয়টি অনলাইন থাকতে পারে। এমন পত্রিকাও দেখা যায় যারা অকেশনালি ছাপে, অন্য সময়ে শুধু ‘সংবাদ সংগ্রহ’ করে। এখানে স্থিতিশীলতা বা শৃঙ্খলা আনতে হলে প্রেসক্লাবকেই একটি উপায় বের করতে হবে। কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করতে হবে যে, কারা কি যোগ্যতায় সাংবাদিকতা করতে পারবেন, কি যোগ্যতায় প্রকাশক, সম্পাদক, নিউজ এডিটর হতে পারবেন। একটি জেলায় কয়টি প্রিন্ট বা অনলাইন থাকবে সেখানেও প্রেসক্লাব ভূমিকা রাখতে পারে।
সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ এখন খুবই জরুরি। প্রেস ইনস্টিটিউট চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রশিক্ষণের। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা এতো বেশি যে সবার প্রশিক্ষণ বোধ হয় কষ্টসাধ্য। এ ক্ষেত্রে প্রেসক্লাব দায়িত্ব নিতে পারে। বিশেষত প্রেসক্লাবের প্রশিক্ষণ ব্যতীত সাংবাদিকতা করা যাবে না মর্মে প্রেসক্লাব নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সচিবালয়ে কিছু নগণ্য সংখ্যক সাংবাদিক পেয়েছি যারা সারাদিন টই টই করে সব মন্ত্রণালয়ে ঘুরে বেড়ান, প্রেস ব্রিফে সামনের সারিতে বসেন, মন্ত্রীর বাইট নেওয়ার সময় সামনে না থেকে পিছনে দাঁড়ান যাতে টেলিভিশনে তার সাংবাদিকতা প্রকট ও প্রকাশ্যভাবে দৃশ্যমান হয়। দিন শেষে অফিসে গিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তাকে কল করেন, “ভাই, নিউজটা আমার মেইলে পাঠিয়েছেন?” হয়তো পরের দিন তার পত্রিকায় সে সম্পর্কিত নিউজটিই দেখা যায় না। কিছু গণমাধ্যমকর্মী আছেন যাদের লিখিত নিউজ কেউ দেখেন না, তিনি কোন মিডিয়ায় চাকরি করেন, সেটা কেউ জানেন না। আবার কেউ কেউ নিজের ‘ছোট’ পত্রিকার ‘বিশেষ নিউজটি’ ‘বিশেষ ব্যক্তির’ নজরে আনতে পত্রিকাটি বগলে করে জনসংযোগ কর্মকর্তার কাছে হাজির হন, তাকে অনুরোধ করেন যাতে নিউজটি মন্ত্রী-সচিবকে দেখিয়ে কোন বিশেষ ব্যক্তিকে আচ্ছারকম শাস্তির ব্যবস্থা করেন।
মফস্বল সাংবাদিকতার বড় সমস্যা ভাষার শুদ্ধ চর্চা। সংবাদের হেডলাইন, ইন্ট্রু বা শব্দচয়ন, বাক্যগঠন ইত্যাদিতে ভালই সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। অনেক ভাল সংবাদও এর কারণে মার খেয়ে যায়। এর একমাত্র সমাধান লেখাপড়া জানা লোককে সাংবাদিকতায় আনতে হবে এবং লেখাপড়া করতে হবে। সরকার এদিকটায় পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। হয়তো কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষত গণমাধ্যমকর্মীর চাকরির নিশ্চয়তা, তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, সংবাদ পরিবেশনজনিত কারণে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট করেছে, প্রেস কাউন্সিল করেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে। তবে উদ্দেশ্যমূলক বা অতিরঞ্জিত সংবাদ ছেপে পরে রিজয়েন্ডার ছাপিয়ে ভুল স্বীকার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সুস্থ সাংবাদিকতার খাতিরে।
আরেকটি বড় সমস্যা নিয়মিত বেতন না পাওয়া, স্বল্প বেতন পাওয়া বা টোটালি বেতনই না পাওয়া। বুম বা কার্ড দিয়ে ছেড়ে দিলেন বেতন ছাড়া আর তার কাছ থেকে ভালো মানের সংবাদ আশা করবেন বা ভাল আচরণ আশা করবেন- তা হতে পারে না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন প্রসারতার একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। হয়তো একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হবে। সংবাদে, প্রকাশনায় একটা স্থিতি আসবে, পেশাদারিত্ব তৈরি হবে। আমরা এ আশাই করছি।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ