জুলাই আগস্ট অভ্যুত্থানের পর খাল-বিল জমিসহ নানধরনের দখলদারিত্বের কবলে সাধারণ মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুর সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ খসরু ইসলামকে হুমকি প্রদান, তার নিজ জমির গাছ-খড় ও ফসল কেটে জমি দখল করেছে কিছু দূর্বৃত্ত ভূমিদস্যু। এ বিষয়ে তিনি একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন সেনা কমান্ডার যৌথ বাহিনী মেহেরপুর ব্যাটেলিয়নে।
অভিযোগ পত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, গাংনী উপজেলার বামন্দী ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে ২৬ নম্বর মৌজায় ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত আমার ছয় ভাই বোনসহ অপর আরো কয়েকজনের তপশীলভুক্ত জমিতে প্রায় এক লক্ষ টাকার খড় এবং এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার বনজ গাছ কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এখন তারা আমাদের উক্ত জমিতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক হুমকিও দিচ্ছে। গত ১৪-১১-২০২৪ তারিখে তারা নালিশী জমিতে জোর করে লাঙ্গল দিয়েছে। ইতিপূর্বে থানা পুলিশ প্রশাসনের কাছে লিখিত অঙ্গীকার দিয়েছিল তারা আমাদের জমিতে কখনো যাবে না। আমাদের বাড়ি থেকে জমির দুরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় আমাদেরকে অসহায় ও দুর্বল ভেবে জমিটা গ্রাস করার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে। জমির সাথে এই সমস্ত দখলদার দুর্বৃত্তদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই বা পূর্বেও ছিল না। তাদের সাথে কোন প্রকার মামলাও নেই। অথচ তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জোর পূর্বক জমি দখল করতে চাই। জমির তপশীল ও পরিমাণ উল্লেখ করেন – মৌজা ২৬ নং রামনগর, খতিয়ান নম্বর আরএস ১৭২,১৭৩,৩৫২,১২৮৩, দাগ নম্বর ২৯৫৬,৩২৭১,২৯৫৮,২৯৫৬,৩১৫৮ এবং জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৪.৫৯ একর, ০.০৮ একর, ০.৩৬ একর, ০. ১৮ একর।
জমিগুলো আসামিদের কবল থেকে মুক্ত করে দিতে সেনা কমান্ডার বরাবর আবেদন করেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. খসরু ইসলাম।
জমির মালিক মো. হারেজ উদ্দিন পিতা মৃত হুজুর আলী সাং গাড়াডোব, থানা গাংনী, জেলা মেহেরপুর। জমির পরিমাণ ০৯.১৪ একর। হারেজ উদ্দিন ২০১৮ সলে মৃত্যুবরণ করলে ছেলে খসরু ইসলামসহ হারেজ উদ্দিনের ছয় সন্তান জমির উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হন।
জমির কাগজপত্র ও দলিলাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় – এটি ছিল মূলত বিনিময় সম্পত্তি। গাংনী থানার বামুন্দী ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে মৃত আব্দুর রহমান এবং ওনার প্রতিপক্ষ মৃত আবু বকর কারিকর নিজেদের স্বত্ব দাবী করে আলাদা আলাদাভাবে তৎকালীন কুষ্টিয়ার ডিসি’র কাছে বিনিময় দলিল পেশ করেন। দুটি দলিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিসি সরজমিনে তদন্ত করে আবু বকর কারিকরের দলিল বাতিল করে দেন এবং আব্দুর রহমানের দলিল গ্রহণ করেন ও এর সত্যতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন। ১৮,০৩,১৯৭৭ তারিখে জেলা প্রশাসক কর্তৃক বিনিময় নিশ্চিতকরণ ও সত্যতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন। ০৮,০৪ ১৯৭৭ তারিখে কুষ্টিয়া ডিসি আব্দুর রহমানের অনুকুলে রেজিস্ট্রি দলিল করে দেন। দলিল নম্বর ৩৯১১। তৎকালীন কুষ্টিয়া ডিসি কর্তৃক দলিল রেজিস্ট্রি দেন যার বিনিময় মিস কেস নম্বও ১০৫(সিএল)৬৬-৬৭।
আবু বকর কারিকর এই দলিলকে চ্যালেঞ্জ করে মেহেরপুর সাব- জজ কোর্টে মামলা করেন ১৯৯৪ সালে। এ মামলায় পরাজিত হয়ে ৯৬ সালে মেহেরপুর জজকোর্টে আপীল করেন। আপীল নম্বর ১৯/১৯৯৬। ২৬/১/২০০৬ তারিখে জেলা জজ, মেহেরপুর কর্তৃক আপীলের চুড়ান্ত রায়ে আবু বকর কারিকর পরাজিত হন। পরবর্তিতে এই জমি নিয়ে আর কোন মামলা মোকদ্দমা হয়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মেহেরপুরের অফিসে জমির কাগজপত্র সাবমিট করলে তিনি ২৬/৭/২০১১ তারিখে খাজনা প্রদানের আদেশ দেন। এরপর ১৯৬২ সাল থেকে খাজনা আপ-টু-ডেট করা হয়। বর্তমানে ওয়ারিশগণ খারিজের জন্য অনলাইনে আবেদন খরেছেন এবং তা প্রক্রিয়াধীন আছে।
জমির মালিকের বসবাসের বাড়ি থেকে জমিটি বিশ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় বারবার দখলকারীদের রোষানলে পড়তে হয় মালিকদের। দখলকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট গাংনী থানায় নালিশ করলে ওসি বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদের থানাতে হাজির হতে বলে। গত ১০/১০/২০১৮ তারিখে দখলকারী ১৭ জন থানায় হাজির হয়। উভয়ের উপস্থিতিতে আলোচনা শেষে ১৭ জন দখলকারী এই মর্মে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে যে, ভবিষ্যতে আর কখনো জমির উপর যাবে না। তিন’শ টাকার স্ট্যাম্পে এই সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এছাড়াও কোন এক সময় এই দখলকারীরা ইউএনও গাংনী বরাবর একটি আবেদন করেছিল এই জমিটি সরকারি খাসজমি তাই আমরা লিজ নিতে চাই বোলে। কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইউএনও গাংনী জমির মালিকানা নিশ্চিত করে এবং তাদের দাবী অগ্রাহ্য করে পত্র প্রেরণ করেন। যার স্মারক নং- ০৫.৪৪.৫৭৪৭.০০০.০৪.০১৭.১৯-৮৮৫, তারিখ- ১১/০৭/২০১৯।
কাগজ-পত্র পর্যালোচনায় আরো দেখা যায় দখলদারদের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারায় মামলা করেন জমির মালিক হারেজ উদ্দিন। সেই মামলাতেও ০৬/০৪/২০১৬ তারিখে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরপুর হারেজ উদ্দিনের পক্ষে রায় ঘোষণা করে। যার মামলা নম্বর- ১৯৬/১৫ (৫২/১২)। উল্লেখ্য রামনগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে এই জমি থেকে হারেজ উদ্দিন ০৭ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যাদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ আনা হচ্ছে, মামলা করা হচ্ছে তাদের সাথে এই জমির কোনোই সংশ্লিষ্টতা নেই। এদের সাথে জমি নিয়ে কোনোদিন মামলা ছিল না। এরা সম্পুর্নভাবে তৃতীয় পক্ষ যারা রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে জমিগুলো জোর দখল করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে জোর করে এই জমির উপরে একটি মসজিদও নির্মাণ করে তারা।
হারেজ উদ্দিনের ০৯.১৪ একর জমির মধ্যে থেকে কিছু জমি ক্রয় করে রামনগর গ্রামের ছবদুলের ছেলে ছাদিমান, আনোয়ার, আলতাব এবং ছহিরুদ্দিনের ছেলে শওকত। এরাও কেউ তাদের ক্রয়কৃত জমি ভোগদখল করতে পারে না।
সম্পুর্ন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দুর্বৃত্তরা হারেজ উদ্দিন ও তার উত্তরাধিকারদের নিজ নামিও জমি থেকে ফসল কাটে নেয়া গাছ কেটে নেয়া খড় কেটে নেয়া এবং অবৈধ ভাবে মসজিদ নির্মাণ করে দখলের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।
৫ আগস্টের পূর্বে দুর্বৃত্তদের নেতৃত্বে ছিলো আওয়ামী লীগের নেতারা। পালাবদলের সাথে সাথে নেতৃত্বে এসেছে বিএনপির নেতারা। কাগজ যার জমি তার আইনে থাকলেও বার-বার সেই জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে জমির মালিকদের।
রামনগর গ্রামের রহমান আলির ছেলে খলিল জমি দখলকারীদের একজন। তাকে জমি দখলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তার কাছে জমির বৈধ কোনো কাগজপত্র নাই বলেও জানান।
রামনগর গ্রামের সাধারণ মানুষ স্বীকার করেন জমির বৈধ মালিক হারেজ উদ্দিন। গ্রামের কিছু লোক অবৈধভাবে দখল করেছে। হারেজ উদ্দিনের সন্তানরা অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। তাদের বারবার এই জমি নিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তারা তাদের জমি ফেরত পাক এটাই গ্রামবাসীর চাওয়া।
শুরু থেকেই চিহ্নিত ২১ জন দুর্বৃত্ত এই দখলের সাথে জড়িত।
তারা হলেন – রামনগর গ্রামের মরজেত কামারের ছেলে মান্নান, আব্দুল কাদেরের ছেলে স্বপন, আব্দুর রহমানের ছেলে খলিল, গোলাম রসুলের ছেলে আলছাব, মকলেছ আলির ছেলে আশাফুল, মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে ছালাম, আফফানের ছেলে ইন্তাজ, আফফানের ছেলে শরিফুল, মৃত আফেল কামারের ছেলে রমজান আলী, আনসার আলী আরোর ছেলে সাজেদুল ইসলাম, নাদের কামারের ছেলে সবকুল, শামছুল হকের ছেলে শিপন আলি, বক্কর আলির ছেলে সুজন আলি, মৃত মরজেত আলীর ছেলে ময়নাল, ময়নাল আলীর ছেলে ইজুল, ছব্দুল শাহর ছেলে কুরবান শাহ, মৃত চমৎকারের ছেলে মহিবুল, মৃত মল্লিক এর ছেলে আফফান, আফফানের ছেলে কুদরত আলী, আফফানের ছেলে সাইদ আলী, আফছারের ছেলে নজিমসহ আরো অনেকে।
এরা সকলেই হারেজ উদ্দিনের জমিতে আর কখনো যাবেনা বলে গাংনী থানায় মুচলেকা দেয়। হারেজ উদ্দিনকে তার জমির দখল থেকে কোনোরূপ উচ্ছেদের চেষ্টা, জুলুম, খবরদারী না করার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে। সূত্র : ফৌজদারী কার্যবিধি ১৪৫ ধারার নোটিশ নম্বর ১৮০/১৬।