স্বামী সংসারে ঠাঁই না হলে সমাজে নারীরা নানা নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপরও তারা আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। এমনই এক আত্ম প্রত্যয়ী ও জীবন সংগ্রামী নারী সাবিনা ইয়াসমীন। যিনি স্বামী হারিয়ে পিতৃ গৃহে ঠাঁই না পেয়ে আত্মশক্তিতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। তার সাহসী উদ্যোগ নারী সমাজে ব্যাপক ভূমিকা অর্জন করেছে। অসহায় এবং সমাজের বোঝা হিসাবে যেসব নারীরা ঘরে বসে থাকতো তারা এখন আশার আলো দেখছেন। এক সময় স্বামীর সংসারত্যাগী হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসায় সমাজের বিভিন্ন মানুষের কাছে কটু কথা শুনতে হয়েছে। সইতে হয়েছে নানা অপমানও। তবুও বেঁচে থাকা ও সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সমাজে আজ প্রতিষ্ঠিত। তাকে অনুসরণ করে নারীরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে নিজদের করেছে প্রতিষ্ঠিত । সাবিনা ইয়াসমিন মেহেরপুরের গাংনীর হাড়িয়াদহ গ্রামের তহির উদ্দীনের মেয়ে।
জানা গেছে, সাবিনা যখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তখন তার বিয়ে হয় গাংনীর থানা পাড়ায়। মাদকাসক্ত স্বামীর অমানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হতো তাকে। ২০১২ সালে এক শিশু পুত্র ও কণ্যাকে রেখে মাদকাক্ত হয়ে স্বামী মারা যায়। শাশুড়ি ননদ ও দেবর ভাসুরের অত্যাচারে সে সময় স্বামীর বাড়িতে ঠাঁই হয়নি সাবিনার। আবার পাঁচ বোন ও এক ভাই তাকে পরিবারে ঠাঁই দেয়নি। অসহায় পিতামাতার কাছেও স্থান পান নি। দুবেলা দু মুঠো ভাতের জন্য নানা কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়েন নি তিনি। সেই স্কুল জিবনে সেলাইয়ের কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। পাশাপাশি হাড়িয়াদহ বাজারের পাশে আকছার আলীর জমিতে একটি ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন। সেলাইয়ের কাজ করে কোন মতে জীবন ধারণ করে আসছিলেন। পরিবারের খরচের পাশাপাশি কিছু টাকা জমিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেটাতো সহজ নয়। সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার তো নারীদের নিত্য সঙ্গী। তার পরও সব বাঁধা অতিক্রম করে স্থানীয় বাজারে একটি দোকান ভাড়া নেন। শুরু করেন সেলাাইয়ের কাজ আর চা তৈরী। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরে নানা ধরণের খাবার, প্রসাধনী পন্য ও মুদি মালামাল বিক্রি শুরু করেন। এখান থেকে যা আয় হয় তাদিয়ে সংসার চালানো পিতা মাতার দেখা শোনা আর সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন সংগ্রামী এই সাবিনা ইয়াসমিন।
হাড়িয়াদহ বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সাবিনার দোকানে থরে থরে সাজানো মালামাল। এক পাশে চায়ের বিকি কিনি। অন্যপাশে সেলাইয়ের মেশিন। মালামাল বিক্রির পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজটিও করছেন। সেই সাথে শিশু কন্যাকে পড়াচ্ছেন। আর বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে মালের অর্ডার দিচ্ছেন বিদায় করছেন পাওনাদারদের। এভাবে সকাল থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত একাই সামলাচ্ছেন সব কিছু। মাঝে মধ্যে বাবা তোহির উদ্দীন এসে কিছুটা সহযোগিতা করেন। বাড়িতে গরু ও হাঁস মুরগি পালন ছাড়াও কীটনাশক মুক্ত সবজি উৎপাদন করেন। সেখান থেকেও আয় হয় বেশ কিছু টাকা। বাবা ও ভাই বোনদেও কাছে ঠাঁই না হওয়া সাবিনার কাছে এখন বৃদ্ধ বাবা মায়ের সব দায়িত্ব তার।
স্থানীয় লোকজনও এখন সাবিনার ভক্ত। আগের মতো সাবিনাকে আর কারো কটু কথা শুনতে হয় না। তার দেখা দেখি অনেক বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তরা সেলাইয়ের কাজ বা দোকানী পেশা বেছে নিয়েছেন।
সাবিনা জানান, জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে স্বামীকে পাশে না পেলেও শিক্ষা জিবনের সেলাই কাজের অভিজ্ঞতা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। ১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন তিনি কিন্তু হাল না ছেড়ে শক্তভাবে হাল ধরেছিলেন বলে আজ তিনি স্বাবলম্বী। একমাত্র আয়ের উৎস সেলাই মেশিন দিয়েই করেছেন ভাগ্যের পরিবর্তন। বাড়ির উঠানের গন্ডি পেরিয়ে তিনি এখন সফল ব্যবসায়ি। তিনি আরো জানান, ছেলে আবু সাইদ নবম শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়ে সুরাইয়া পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। মহামারী করোনার কারণে ছেলে মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়। আবার চালু হয়েছে স্কুল। এখন তারা আবার বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে। ওদের নাওয়া খাওয়া শেষ করে বিদায় দিয়ে শুরু হয় ব্যবসার কাজ।
সাবিনার সংসার পরিবার পরিজন নিয়ে কোন মতে দিন যাপন করলেও তার বসবাসের জায়গাটি নেই। ইতোপূর্বে সরকারী ঘরের জন্য আবেদন করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। ঘর পেলে সাবিনা একটু শান্তিতে থাকতে পারতো বলেও মন্তব্য করেছেন।
সাবিনার প্রতিবেশি ওসমান জানান, সাবিনার এই জিবন সংগ্রামে তারা আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারলেও সাহস জুগিয়েছেন। সাবিনা এখন একজন ব্যবসায়ি। তার মতো সমাজের নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একই কথা বলেছেন অপর প্রতিেিবশি মারুফ হোসেন।
সাবিনার বাবা তোহির উদ্দীন জানান, অর্থাভাবে মেয়ে সাবিনাকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। সেই বাল্য বয়সে বিয়ে দেয়া হয়। নিজেরই কোন আয় রোজগার নেই। মেয়ের স্বামী হারানোর পর তাকেও জায়গা দিতে পারেননি। তার পরও সাহস দিয়েছেন। এখন মেয়েই তার দেখা শোনা করছেন।
জেলা সমাজ সেবা অফিসের রেজিষ্ট্রেশন অফিসার আরশাদ আলী জানান, জেলায় বিধবা,স্বামী পরিত্যক্তা ও নিগৃহীত নারীদের বাছাই করে সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি নারীকে সরকারি ভাতা প্রদান করে থাকি। তবে নারীদের আত্ন প্রত্যয়ী করে তুলতে সামাজিক উৎসাহ যোগাতে হবে। সমাজের অনেক কুসংস্কার নারীদের পিছিয়ে রেখেছে। পরনিন্দার ভয়ে অনেক নারীরাই কর্ম করতে না পেরে নিরবে দুঃখ কষ্ট সহ্য করে চলেছে।
এ ব্যাপারে রাইপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম সাকলায়েন ছেপু জানান, আমাদের সমাজে নারীদেও কাজ কওে সংসার চালানো কিংবা হাট বাজারে যাওয়াটা মানুষ ভাল চোখে দেখেনা। সমাজের মানুষ কারও রুটি রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে দিতে না পারলেও পিছন থেকে আজে বাজে কথা বলতে ভালই পারেন। তবুও সাবিনা সব কিছুর তোয়াক্কা না করে কারো বোঝা না নিজেই সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। সাবিনার আজ সুদিন । আমাদের সমাজে অনেক নারী রয়েছেন যারা স্বামীর বাড়িতে ঠাঁই পাইনি। বাবা মা কিংবা ভাইদের কাছেও আশ্রয় পাচ্ছেন না। তাদের উচিৎ বিভিন্ন কর্মেও মাধ্যমে তাদের জীবন পরিচালনা করা।
মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নীল হাফিয়া বলেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা নারীদের আত্নপ্রত্যী করে তুলছি। সেলাই,ব্লক বাটিক,বিউটি ফিকেশনসহ নানা ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে অসংখ্য নারী তাদের আত্ন নির্ভশীল করে তুলছেন। অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান সরকার। অসহায় ও প্রশিক্ষিত নারীদের বিভিন্ন ভাবে সরকারি সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে এবং সরকারি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের সমাজ পরিবর্তনের একটি উদহারণ। সে কারো সহযোগীতা ছাড়ায় নিজেন অসহায়ত্ব জীবনের অবসান ঘটিয়ে আজ সাবলম্বী। স্বামী সংসার ছেড়ে আসা নারীরা বাবা মায়ের বোঝা হয়ে যায়। আমারা এবং সমাজের সকলে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগীতা,সাহস এবং উৎসাহ দিলে অনেকেই কর্মে নিজেকে আাত্ন নিয়োগ করে নতুন ভাবে বাাঁচার অনুপ্রেরণা পাবে। মেহেরপুরে এমন আত্ন প্রত্যয়ী ও জয়িতা রয়েছে শতাধিক। তারা তাদের নিজের জীবনের সাথে সমাজের সাথে সংগ্রাম করেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন।