সভ্যতারও অনেক আগে, প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের সুচনালগ্ন থেকেই মানুষ আর গরু একত্রে সংসার করে আসছে। মানুষ ব্যতিত গরু যদিও বা কল্পনা করা যায়, কিন্তু গরু ছাড়া মানবসমাজ সম্ভবপর নয়। অবশ্য গরুর কথা বললেই বাঙালি মুসলিম মানসে ভেসে ওঠে ভুনা ভুনা গো-মাংসের ছবি, যদিও মাংস উৎপাদনই গরুর একমাত্র কাজ নয়। গরুর সমগোত্রীয় আরেকটি প্রাণী হল মোষ, অথচ গরু নিয়ে সারা দুনিয়ায় যে পরিমাণ মাতামাতি হয়, মোষের ক্ষেত্রে তার কানাকড়িও নয়!
গরু বিপন্ন শ্রেণির জন্তু না হলেও, নিজেদের জাত চেনার স্বার্থে ছাত্রছাত্রীদের উঠতি বয়সেই গরু রচনা মুখস্ত করিয়ে নেওয়া হয়। কারণ শিক্ষকের দৃষ্টিতে ছাত্ররা ওই শ্রেণির চতুষ্পদ বৈ তো নয়! মানুষের মতো গরুদের মধ্যে ধর্ম চর্চা না থাকলেও, তাদের মধ্যে জাতিভেদ, বর্ণভেদ বিদ্যমান। দেশি জাতের গরু ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রিজিয়ান, সিন্ধি, সুইস, নেপালিসহ বিভিন্ন জাতীয়তা এবং চমরী গাই, গয়াল, নীল গাইয়ের মতো কয়েকটি গোত্রের গরু আছে। দেশি গরুর শারীরিক গঠন ও উৎপাদনশীলতা আমাদের মতোই স্বল্পকায় এবং নামসর্বস্ব।
বৃক্ষের মধ্যে যেমন কাঁঠালের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, কাঁঠালের পাতা, ডালপালা, ফলের আবরণ, বীজ কোনোকিছুই যেমন ফেলনা নয়; এমন কি, এর শেকড় পর্যন্ত ঔষধি কাজে লাগানো হয়। প্রাণীকুলের মধ্যে গরুও তেমন সর্বগুণে মহিমান্বিত বহু ব্যবহারোপযোগী জন্তুবিশেষ। মানুষ এদের থেকে মাংস ও দুধ আহরণ ছাড়াও এদের চামড়া, হাড়, নাড়িভুঁড়ি, গোবর সব-ই কাজে লাগাচ্ছে। এমন কি বিশেষ মতাবলম্বী এক শ্রেণির মানুষ, গরুর প্রস্রাবকে ওষুধ হিসেবে সরাসরি গলাধঃকরণ করছে।
আধুনিক সমাজে, ব্যস্ত সময়ে গরু ছাড়া একটি ধাপ ফেলার কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ থাকবেও বা কীভাবে? গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি জুতোতে পা গলিয়েই না হাঁটতে হবে! কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা সঙ্গে নিতে হলেও সেই চামড়ার তৈরি ওয়ালেট লাগবে। ইজ্জত কষে বেঁধে রাখতেও কোমরে চামড়ার বেল্ট আঁটতে হবে। উৎসবে-পার্বণে, আনন্দ আয়োজনে গরুর দুধের ছানা ফেটা মিষ্টি তো চাই-ই চাই। জীবনের প্রয়োজনে ফসল ফলাতে যেমন গোবর সারের দরকার হয়, তেমন জীবন রক্ষাকারী ক্যাপসুল তৈরিতেও গরুর হাড় চাই। গরুর হাড় আর ক্ষুরা দিয়ে আরোও কত কী যে তৈরি হয় তার খবর রাখে ক’জন? একালে গোবর শুকিয়ে জ্বালানি বানানোর চল না থাকলেও বায়োগ্যাস উৎপাদন করে একই কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে।
পেছন ফিরেও যদি দেখি; আমাদের জীবনধারণের অবলম্বন কৃষি ও কৃষকের দিকে, কৃষকের অবলম্বন ছিল গরু। জমিতে হাল বইতে, মই দিতে যেমন গরুর বিকল্প ছিল না। তেমন ফসল ওঠার পরে মাড়াই করতে ওই গরুই ছিল নীলমণি। ভোজনবিলাসি বাঙালির রান্নার তৈল উৎপাদনের কলু ঘোরাতেও ওই গরুর দ্বারস্থ হওয়া ভিন্ন পথ ছিল না। রাজাধিরাজরা ঘোড়া গাড়িতে চড়ে বেড়ালেও গণপরিবহন বলতে যা ছিল, তা হল গরুর গাড়ি। ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানে যখন নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন গলা মিলিয়েছিলেন, সেই সময় কত তরুণী এমন গরুর গাড়িতে চেপে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন দেখত তার ইয়ত্তা নেই! ইলিয়াস কাঞ্চন এখন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ সড়কের দাবীতে, উনি কি দুর্ঘটনার আশঙ্কামুক্ত সেই গরুর গাড়িই আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছেন কি না, তা অবশ্য আমার জানা নেই।
গরু যে শুধু স্থুল পার্থিব কাজেই ব্যবহৃত হয়, তা নয়। ধর্ম-কর্মের ভেতরেও গরুর বেশ সুদৃঢ় একটি অবস্থান রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সর্ববৃহৎ সুরা বা অধ্যায়টির নাম, বাকারাহ। যার অর্থ গাভী। ইসলামে অবশ্য গরুকে পূজনীয় করা হয়নি, বরং ইহুদিদের গরু বিষয়ক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিরোনাম করা হয়েছে। গরুর প্রতি ইহুদি জাতির দুর্বলতা অনেক পুরনো। নবীর অনুপস্থিতিতে তারা উর্বর মস্তিষ্ক ব্যবহার করে একবার বাছুর পূজো করে। এর জরিমানা হিসেবে তাদের দিয়ে একটি গাভী কুরবানি করানো হয়। ইহুদি জাতি এখনো ‘রেড হফার’ নামক এক লাল গরুর সন্ধানে আছে। এই গরু পেলে সেটির বদৌলতে তারা নাকি পুরো বিশ্বকে পদানত করতে পারবে। অবশ্য বর্তমানে আমরা যেভাবে তাদের কাছে গরুর মতোই বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছি, তাতে আবার আলাদা করে গরু খোঁজার কী প্রয়োজন সেটি আমার বোধগম্য নয়!
হিন্দু ধর্মে তো গরু একটি কিংবদন্তী নাম। দেবকুল শিরোমণি শিবের বাহন ছিল গরু। ভগবানের বিমূর্ত রূপ শ্রী কৃষ্ণকেও বেষ্টন করে থাকত কয়েকটি গরু। হিন্দু ধর্মমতে গরু দুগ্ধদায়ি মাতা, যেহেতু মাতা তাই পূজ্য। যেহেতু পূজনীয়, তাই জবাই করে খাওয়া নিষিদ্ধ। ব্রিটিশ ভারতে গরু খাওয়া নিয়ে কত যে দাঙ্গাহাঙ্গামা, কত যে অনর্থ হয়েছে তার সীমা পরিসীমা নির্ণয় কঠিন। অধুনা ভারতেও গরু নিয়ে হাঙ্গামা বিদ্যমান, তবে সেটি একতরফা। একসময় তো দেশে ব্যক্তির ধর্ম পরিচয় চিহ্নিত হতো গরু দিয়ে; ব্যাপারটা এমন ছিল, যেহেতু সে গরু খায়, অতএব সে মুসলমান। হালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসারের ফলে বাঙালিরা ধর্ম নির্ণয়ের এ মহা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে অনেকে কুরবানি করা গরুর চোয়াল বাসায় টানিয়ে রাখে। যদিও এটি কুসংস্কার হিসেবে বিবেচিত, তবুও সংস্কার তো বটে!
গরু নিয়ে ধর্মীয় আবেগ থাকবে, আর তা নিয়ে সমাজে চালবাজি হবে না, রাজনীতি হবে না তা আশা করা বোকামি। একচেটিয়া মুসলিম সমাজে গরু নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও, হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এর প্রভাব চরম। শরৎচন্দ্র তাঁর ‘মহেশ’ গল্পে সেই বিষয়টি বেশ ভালো করেই এঁকেছেন। ভারতে গো-রক্ষা ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করে যারা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন, তারা-ই আবার গো-মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করে রপ্তানি বাণিজ্যে শীর্ষে ওঠার কসরতে কসুর করেন না। ভারতে গরু নিয়ে যা যা ঘটে তা লিপিবদ্ধ করতে হলে প্রমাণ সাইজের একটি গ্রন্থ রচনা ছাড়া উপায় নেই। গরুকে কেন্দ্র করেই সমাজে রাখাল, গোয়ালা, ঘোষ প্রভৃতি পরিচয় জ্ঞাপক বিশেষ্যের উদ্ভাবন ঘটেছে।
বাংলা লোককথা কিংবা সাহিত্যেও গরুর অবস্থান দুর্বল নয়। উস্তাদ আহমদ ছফা তো ‘গাভী বিত্তান্ত’ শিরোনামে উপন্যাস লিখে বাঙালি এলিট শ্রেণির গরুপ্রীতি উন্মোচন করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মীর মশাররফ হোসেন অবশ্য তাঁর ‘গো-জীবনে’ ইনিয়ে বিনিয়ে গরু খাওয়া থেকে মুসলমানদের সরে আসার আন্দোলন করে গিয়েছেন। গরু নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন ছড়িয়ে আছে। বাংলা জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের একটি হল ভাওয়াইয়া, আর এর উৎস হল গরুগাড়ি। ওয়েস্টার্ন গল্প আর ছায়াছবির প্রায় সব-ই গরুময়। তৎকালীন টেক্সাস আর মেক্সিকোতে যে মানুষের সভ্যতা আবর্তিত হতো গরুকে কেন্দ্র করে, এখান থেকে সেটি বিলক্ষণ উপলদ্ধি করা যায়!
দেশের বর্তমান অর্থনীতিতে গরু অনেক শক্তিশালী একটি উপাদান। গরু এবং গরু থেকে প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন উপকরণ জিডিপি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র লাঘবেও গরুর ভূমিকা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই সভ্যতা বিনির্মাণে মানুষের পরে যে প্রানীটির অবদান, সেটি গরু!
গরু বিষয়ক কড়চা শেষ করার আগে দুটি কথা। আমাদের সমাজে নিরীহ নির্বিবাদী লোকদের কেতাবি ভাষায় ‘গো-বেচারা’, ভদ্রলোকি ভাষায় ‘গরু’ আর সাধারণার্থে ‘বলদ’ বলে সম্বোধন করা হয়। ‘বলদ’ গরু সমাজের একজন সদস্য। আক্ষরিক অর্থে যে গরুটির পুরুষত্বহীনতা ঘটানো হয়, সেটি বলদ হিসেবে বেড়ে ওঠে। কিন্ত প্রচলিত অর্থে বোকা বা অগভীর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বলদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বলদের যে বৈশিষ্ট্য, সমগ্র গরুসমাজ সেই দোষে দুষ্ট। মানবজাতির উপকারার্থে তাদের বশ্যতা মেনে নিয়ে নিজেকে বলিদান দেওয়াটাই বলদের বা গরুর ধর্ম। সেই হিসেবে বলদ গালি নয়, প্রশংসা। গরুর চরিত্র যদি মানুষের মতো হতো, তাহলে কবি লিখতেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে গাই।’
এম এম জাকির হোসেন প্রকৌশলী, ত্রাণ শাখা zakirkhalid776@gmail.com