বাংলাদেশ জন্ম ইতিহাসের প্রবেশদ্বার মেহেরপুরের মুজিবনগর। এই পবিত্র ভূমিতে নানা ধর্ম-বর্ণ, মত-পথ, সম্প্রদায়ের বসবাস। সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের বামনপাড়া গ্রাম-এখানেই বসবাস করছে দাস সম্প্রদায়ের ৭০টি পরিবারের ২৬০জন মানুষ। স্থানটি দাসপাড়া হিসেবে পরিচিত। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের চলতে হয় ভগবানের উপর ভরসা করে।
অনুসন্ধানে যতটুকু জানা যায় প্রায় শতবছর ধরে এখানে দাসদের বসবাস। পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, জগন্নাথপুর, মেহেরপুরের শিবপুর, ভবানন্দপুর, গাড়াডোব থেকে উঠে এসে জীবিকার তাগিদে, এখানে বসতি গড়ে তোলে। প্রথম দিকে ১০/১২টি পরিবার থাকলেও বর্তমানে পরিবার সংখ্যা ৭০টি। দাস সম্প্রদায় তিন ভাগে বিভক্ত যেমনÑ ঋষি সম্পাদয়, রুহি সম্প্রদায় এবং কৈবর্ত সম্প্রদায়। তবে এখানে সবাই ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ।
এদের প্রধান পেশা ক্ষুদ্র বাঁশ-শিল্প। বাঁশের তৈরি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ভাষায় ঝুড়ি, টুকা, শরপস বা খাচি, চাটায়, হাস মুরগী রাখার জন্য এক ধরনের টাপা/ঝুড়ি, আম মৌশুমে আম বহন করার জন্য বিশেষ ঝুড়ি সহ নানান সৌখিন সামগ্রী। পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির বউ, লেখাপড়া করা সন্তানেরাও এই কাজে সাহায্য করে থাকে। ৫০ থেকে ৪০০ টাকা দামের ঝুড়ি এখানে তৈরি হয়। কেউ কেউ অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য ভ্যান চালায়। আধুনিকতার সাথে তাল রেখে আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে কুলা, ঝুড়িসহ বাঁশের তৈরি অনান্য সামগ্রীর ব্যবহার। প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে একমাত্র বাঁশের কাজ জানা এই সম্প্রদায়ের মানুষ গুলো বেশ অর্থ কষ্টে ভুগছে। অর্থ কষ্টের কারণে বিভিন্ন সময় কেউকেউ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ একটু উন্নত জীবনের আশায় ভারতেও পাড়ি জমিয়েছে।
দাসপাড়ার ৭০ পরিবারের মোট জমির পরিমাণ ৪ বিঘা মতো হবে। বেশিরভাগ পরিবারেরই এক কাঠা করে জমি, কয়েক জনের আছে ৩ কাঠা এবং একমাত্র মকুচ চন্দ্র দাসের আছে ৫কাঠা জমি। মাঠে চাষের জমি ১ জনেরও নাই। প্রত্যেকের বসবাসের ঘরগুলো চাটায়ের বেড়া উপরে টিন কারো বা আঁধাপাকা ইটের গাঁথুনি উপরে টিন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য দরুদ আলী বলেন- এদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় লাগায়, এরা মানুষ ভালো, কারো সাথে কোন বিরোধে জড়ায় না। ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পের অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তেতুল দাস ও পারুল দাসকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। আরও ১০ টা পরিবারকে ঘর দেয়া হবে, অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
দাস সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়াতেও আগ্রহী হয়েছে। সুদেব কুমার দাস, নয়ন কুমার দাস, উজ্জ¦ল কুমার দাস এই তিনজনই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে থেকে একাউন্টিং এ অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছে ৪ বছর আগেই। যদিও কোথাও এখনো চাকরি হয়নি। সুদেব কুমার দাসের আক্ষেপ- নিকট আত্মীয় অথবা টাকা না থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন। এখন বাঁশের কাজ করছি আর প্রাইভেট ফার্মে চাকরির চেষ্টা করছি, ভগবান হয়ত একদিন কৃপা করবে। সুমন দাস, চুমকী দাস, সীমান্ত দাস কলেজে পড়ছে। স্কুলেও যাচ্ছে ২০/২৫ জন ছেলে মেয়ে।
অল্প জায়গাতে বসবাস হওয়া সত্ত্বেও দাসপাড়ার মানুষদের প্রার্থনার জন্য একটি মন্দীরের জায়গা আছে। চাটাইয়ের বেড়া উপরে টিন দিয়ে ঘর করে সেখানেই প্রতি বছর মহা উৎসবে দূর্গাপূজা হয়ে থাকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে দূর্গাপূজা অনুষ্টিত হচ্ছে। মন্দীরের নাম দাসপাড়া কালী মন্দির। মন্দীরের সভাপতি মুকুল চন্দ্র দাস বললেন, এ বছরে সরকার আমাদের মন্দীর নির্মাণের জন্য ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। ভগবানের কৃপায় অচিরেই কাজ শুরু করবো। মুকুল চন্দ্র দাসের বয়স হয়েছে বিধায় দাসপাড়ার গোষ্টি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে মাধব চন্দ্র দাস। নিজেদের মধ্যে বিচার শালিসসহ শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্যে নিজেদের তৈরি কিছু আইন কানুন বিধি নিষেধ আছে যা এখানে সকলেই মেনে চলে। মাধব চন্দ্র দাস বলেন- আমরা গরীব- ভগবানে’র কাছে আমরা সবসময় প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ভালো রাখেন। আমরা নিচু শ্রেণী হলেও ভগবান আমাদের সাথে আছেন। এখন দূর্গাপূজা শুরু হয়েছে দাসপাড়ার মানুষ সকলেই আনন্দের সাথে পূজা উদযাপন করছে। করোনার কারণে সরকারের বিধি নিষেধও মেনে চলতে হচ্ছে।
লক্ষণ দাস বলেন- আমার এক ছেলে এক মেয়ে। একজন ৮ম ও একজন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। আমি বাঁশের কাজের পাশাপাশি ভ্যান চালাই। সবমিলিয়ে ৭-৮ হাজার টাকা মাসে আয় হয়। সংসার চালিয়ে ছেলে মেয়েকে পড়ার খরচ দিয়ে ভগবানের কৃপায় ভালো আছি।
দাসপাড়ার নিকটেই শ্মশানঘাট সেখানেই তাদের মরদেহ মাটি দেয়া হয়। দাস সম্প্রদায় মরদেহ দাহ করে না।
দীর্ঘদিন থেকে দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে আসা এই সম্প্রদায় অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। দেশ সমাজ এমনকি তাদের জন্মের প্রতিও তারা বিতশ্রদ্ধ। দারিদ্র ও নানান প্রতিকুলতার কষাঘাতে এই সম্প্রদায়টি আজ দেশ, গোত্র, ধর্ম ত্যাগ করলেও তাদের প্রতি আজকের আধুনিক সমাজ তথা সমাজপতিরা কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পেরেছে- পেরেছে পাশে দাঁড়াতে। তাদের নির্ভরতা সেই ভগবান ছাড়া আর কেউ নাই।
আমদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনারুল ইসলাম জানান, বামনপাড়ার দাস পল্লিতে বসবাসরত সদস্যরা অন্যান্যদের মত বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধাব ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্দীরের পাকাকরণের ভিত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বাশ শিল্প কুটির শিল্প। ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।