ঝিনাইদহের এক দিনমজুরের মেয়ে মনিরা মাত্র ১৩ বছর বয়সে বসতে হয় বিয়ের পীড়িতে। অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী মনিরার বিয়ের পর দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এখন আর মনিরা স্বামীর কাছে যেতে চায় না। মনিরার পিতা জানান, দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ। পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেরা ঝামেলা করে। মেয়েও ঠিক মতো পড়তে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে মেয়ে বিয়ে দিতে হয়। এখন সে আর স্বামীর কাছে যেতে চায় না। একই ভাবে গোবিন্দুপর গ্রামের রমেচা খাতুন (ছদ্ম নাম) কে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বসতে হয় বিয়ের পীড়িতে।
বিয়ের দিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বংকিরা পুলিশ ফাড়ির সদস্যরা বর পক্ষকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। বিয়ে না করার শর্তে থানায় উভয় পক্ষ মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়। গোপনে তারা সেই মেয়েকেই আবার বিয়ে করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মনিরা ও রমেচা খাতুনের মতো কিশোরীদের এখন ঠাঁই হচ্ছে স্বামীর ঘরে। যে বয়সে স্কুলের উন্মুক্ত মাঠে হৈ হুল্লোড় আর পড়ালেখা করে সময় কাটানোর কথা সেই বয়সে “সংসার” নামে এক অজানা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করছে।
এমন এক কিশোরী হচ্ছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না মাঝেরপাড়া গ্রামের ইয়াসমিন। নিজ গ্রামের একই বয়সী ছেলে আশিকুল ইসলামের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করে ইয়াসমিন। বিয়ে মানতে নারাজ ছেলের পিতা জাহিদুল ইসলাম। প্রেমের বিয়ে মেনে নিতে না পারায় হতাশায়গ্রস্থ ইয়াসমিন বিষপানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সদরের গোবিন্দপুর ও হরিণাকুন্ডুর দারিয়াপুর গ্রামে অপ্রাপ্ত বয়সি ছাত্র ছাত্রীরা প্রেমের সম্পর্ক করে বাড়ি ছাড়া হয়।
বয়স না হওয়ায় স্থানীয় চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে তারা বাড়ি ফিরে আসে। হরিণাকুন্ডুর ভাতুড়িয়া গ্রামের কলেজ পড়ুয়া যুবকের সঙ্গে একই এলাকার দশম শ্রেনীর ছাত্রী পালিয়ে ঘর বেধেছে। মেয়ের বয়স কম হওয়ায় তাদের বিয়ে রেজিষ্ট্রি হয়নি। মেয়ের পক্ষ এখনো বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। সদর উপজেলার সুরাট গ্রামের এক ভ্যান চালকের প্রেমে পড়ে কোটচাঁদপুরের এক স্কুল ছাত্রী ঘর ছাড়ে। একই ভাবে সাতক্ষিরা শহরের এক স্কুল ছাত্রী পালিয়ে এসে মিয়াকুন্ডু গ্রামে এসে ওঠে। এ ভাবে জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে অসম প্রেম আর বাল্য বিয়ের হিড়িক পড়েছে। করোনাকালে অলস জীবন, মোবাইল ও ইন্টারনেট সুবিধার কারণে টিনএজারদের বিপথগামী করছে বলে অনেকে মনে করেন।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লক্ষি রানী জানান, তার স্কুলের দুইজন ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও গোপনে গোপনে বাল্য বিয়ের খবর আসছে। তিনি বলেন করোনাকালীন সময়ে যৌথ পরিবারে বসবাস করতে গিয়ে অনকে সময় ঝগড়াঝাটি হচ্ছে। ঝিনাইদহ শহরের ব্যাপারীপাড়া, হামদহ ও আদর্শপাড়ার মহিলা ছাত্রাবাসের মালিকগন জানান, করোনা মহামারির কারণে তাদের মেসের প্রায় সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।
এখন প্রতিটা মেসে নতুন নতুন মেয়ে আসছেন। গ্রামাঞ্চলে খুব গোপনীয়তার সঙ্গে বাল্য বিয়ে সম্পন্ন করনা হচ্ছে। প্রশাসন ও পুলিশ সক্রিয় থাকায় এক জেলা থেকে অন্যজেলায় নিয়ে বিয়ে হচ্ছে। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সী ফিরোজা সুলতানা জানান, বাল্যবিয়ের হার কমাতে আমরা নিরলস ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সেই উদ্যোগও ছিল চোখে পড়ার মতো।
কিন্তু মহামারি করোনা আমাদের সে সাফল্য অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁডড়িয়েছে। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্দ থাকায় একদিকে অল্পবয়সী ছেলেরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কৃষি কাজের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করছে। তারা ২১ বছরের আগেই বিয়ে করে বসছে। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকগণ হতাশ হয়ে পড়ছেন ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে। অনলাইনে ক্লাস করারও সুযোগ পাচ্ছেনা এসব ছেলেমেয়েরা। সঙ্গত কারণেই তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।
কেও কেও বইপত্রের সাথে একেবারেই সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলছে। এ সব অভিভাবকগণ তাদের দৃষ্টিতে ভাল পাত্র পেলেই অতি গোপনীয়তার সাথে কিশোরী মেয়েকে পাত্রস্থ করছেন। অল্পবয়সী এ সব মেয়ে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক ও মানসিকভাবে খাপ খাওয়াতে না পেরে সংসার বিমুখ হয়ে স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে আবার ফিরে আসছে পিতার ঘরে। এতে করে সংকট আরো বাড়ছে। তিনি বলেন এ সংকট মোকাবিলায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত কিশোর-কিশোরী ক্লাব সমূহ। ক্লাব প্রশিক্ষকবৃন্দ ও জেন্ডার প্রমোটারগণ তাদেরকে এ সব সংকট উত্তরণে পথ দেখাচ্ছেন। ঝিনাইদহের সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে মুলত এই সমস্যাটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। তিনি বলেন মোবাইল ও ইন্টারনেট এক্সেসের কারণে অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা ছেড়ে মোবাইলে আসক্তি হচ্ছে। এ নিয়ে পিতা মাতার সঙ্গে ঝগড়া বা বাগবিতন্ডায় লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েকে সংসারের বোঝা মনে করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। মানবাধিকার কর্মী টুকু জানান, তার নিজ গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ের এমন ১০ স্কুল ছাত্রীর মেয়ের বিয়ের খবর তিনি পেয়েছেন। এছাড়া প্রায় তিনি বাল্য বিয়ের খবর শুনে ছুটে যাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকায়। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারিতে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি দেখার হার। বেড়েছে আসক্তি।
গত বছর থেকে তেমনই বলছে নানা পরিসংখ্যান। অতিমারির কারণে ঘরবন্দি থাকার ফলে বেড়েছে নেটমাধ্যম বা অনলাইনে সময় কাটানোর প্রবণতা। তারই হাত ধরে উঠে এসেছে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তিও। মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গের মতে, গত এক বছরে অনলাইনে তিন ধরনের কাজের মাত্রা বিপুল ভাবে বেড়েছে। সেটা হচ্ছে জুয়া খেলা, অনলাইনে কেনাকাটা এবং পর্নোগ্রাফি দেখা। পর্নোগ্রাফি অতিরিক্ত দেখার ফলে ‘‘বয়ঃসন্ধির অনেকেরই পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে। ব্র্যাকের গবেষা সূত্র মতে, করোনা মহামারীর মধ্যে দেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারনে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারী দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বিদেশ থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়াও বাল্যবিবাহের কারন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ডাঃ জাহিদ আহমেদ জানান, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে মাঠকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা করোনা সচেতনতার পাশাপাশি বাল্য বিয়ের ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলছে। তিনি বলেন আমরা খবর পাওয়া মাত্রই বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করছি। এরপরও যদি গোপনে গোপনে কোন অভিভাবক বাল্য বিয়ে দেয় সেটা আমাদের অজান্তেই ঘটছে।