ঝিনাইদহে সম্প্রতি অপারেশনের পরে রোগী মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে অনেকগুলো বিষয় সামনে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের ডাক্তার ও সেবিকাদের অবহেলা, অপারেশনের আগে রোগীর শারীরিক অবস্থা যাচাই না করে অপারেশন করা, এ্যানেস্থেসিয়ার সঠিক প্রয়োগ না করা, সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষিত নয় এমন ওষুধের ব্যবহার ও অপারেশনের সময় মানহীন ওষুধ ব্যবহারের বিষয়গুলিই সামনে এসেছে।
সম্প্রতি ঝিনাইদহে পাইকারী ওষুধ বিক্রেতাদের এক রকমের দৌরাত্ম্য সৃষ্টি হয়েছে। ওষুধ প্রশাসনের সঠিক তত্ত্বাবধান ও সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেশি লাভের আশায় অপারেশনের টেবিলে যাচ্ছে হোল সেলারদের মানহীন ওষুধ। শুধু অপারেশনের টেবিলেই নয় হোল সেলারদের কাছ থেকে কেনা মানহীন এই ওষুধ যেকোন রোগীর জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে। জেলার ফার্মেসি মালিক সমিতির সদস্যরা ড্রাগ লাইসেন্স না নিয়ে হোল সেলারদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে জেলার ওষুধ প্রশাসনকেই দায়ী করছেন। তবে এবছর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত নয় এমন দোকানের ওষুধ ব্যবহারের কার্যকারিতা বলে মনে করেন ফার্মেসি মালিকরা।
সম্প্রতি ঝিনাইদহের বেসরকারি ক্লিনিক ইসলামী প্রাইভেট হাসপাতাল লিমিটেড’এ এ্যাপেন্ডি সাইডের অপারেশনের পর সুচনা জান্নাত (১৫) নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় সুচনার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ঝিনাইদহ সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এই মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা রোগীর শারীরিক অবস্থাকে দায়ী বলেছেন। কিন্তু রোগীর স্বজনদের দাবি বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত মাত্রায় এ্যানেস্থসিয়া ব্যবহারের ফলে রোগী অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে খিচুনি ওঠাসহ অবস্থা খারাপ হলে ঢাকায় নেওয়া হয় সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শুধু ইসলামী প্রাইভেট হাসপাতালই নয়, হাসান ক্লিনিক, শামীমা ক্লিনিক, প্রিন্স হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রাবেয়া ক্লিনিকসহ কালীগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে অপারেশনের পর রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে জেলা বিএমএ শাখার নেতৃবৃন্দ হোল সেলে বিক্রি করা ওষুধকেই রোগীর মৃত্যুর জন্য দায়ী বলছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ঢাকার মিটফোর্ড মার্কেট, কুমিল্লার শাসনচর, খুলনার হেরাজ মার্কেট ও চট্টগ্রামের হাজারী মার্কেটে হোলসেল ওষুধ বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে তুলনামূলক অনেক কম মূলে ব্রোকাররা ওষুধ কিনে এনে লোকাল মার্কেটে বিক্রি করে। এসব হোলসেল বিক্রেতারা ওষুধ সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করেন না। যেকারণে ওষুধের কার্যকারিতা হারায়। এছাড়া অনেক অসাধু ব্যবসায়ীরা ওষুদের মেয়াদ টেম্পারিং করে সেই ওষুধ বিক্রি করে। জানাগেছে, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো কয়েকটি রেটে বাজারে ওষুধ বিক্রি করে। সেগুলো হলো, ক্লিনিক্যাল রেট, ইন্সটিটিউট রেট, সরকারি রেট, ডক্টর কাম কেমিস্ট্রি রেট, বোনাস রেট, ফ্লাট রেট, হোলসেল রেট ও রিটেইলার রেট। বেশির ভাগ কোম্পানি রিটেইলার বা ফার্মেসিগুলোকে ১২-১৩% কমিশন দেয়। ওষুধের দামের সাথে কোম্পানিগুলো ১৭.৪% ভ্যাট কেটে রাখে। সেখানে ফার্মেসি মালিকরা হোল সেলারদের কাছ থেকে ওষুধ নিলে কমিশন বেশি পায় এবং ১৭.৪% ভ্যাট দেওয়া লাগে না। যেকারণে তারা বেশি লাভের আশায় হোল সেলারদের কাছ থেকেই ওষুধ কিনে বিক্রি করে। ওষুধ প্রশাসনের নিয়মানুযায়ী পাকা মেমো সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, রয়েছে সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখার কথা।
সূত্র বলছে জেলার বেশিরভাগ ক্লিনিকগুলোতে হোল সেলারদের কাছথেকে সার্জিক্যাল ওষুধ কিনে সেগুলো অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহার করে থাকে। যেসব রোগীর সাথে অপারেশন থিয়েটারের ওষুধের চুক্তি থাকে সেই সব অপারেশনের ক্ষেত্রে হোল সেলারদের কাছথেকে কেনা কম দামের ও মানহীন ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত ৩০ থেকে ৩২ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয় তবে ওষুধের প্রকারের ওপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদা তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু হোলসেলাররা সাধারণ পরিবহনে ওষুধ পরিবহন করে সেগুলো সাধারণ গুদামে সংরক্ষণ করে বিক্রি করে। এদিকে জানাগেছে, কয়েক প্রকারের এ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। যেমন স্প্রে, লোকাল, স্পাইনাল কর্ড ইনজেকশন ও জেনারেল এ্যানেস্থেসিয়া। জেনারেল এ্যানেস্থেসিয়া আবার দুই প্রকার। ইনজেকশন ও মাস্ক।
ঝিনাইদহে মাস্ক এ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহারের একটি মাত্র মেশিন আছে ডাক্তার রেজা সেকেন্দারের। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, বয়স, রোগীর শারীরিক সক্ষমতা ও রোগের ধরণের ওপর ভিত্তি করে এ্যানেস্থেসিয়ার মাত্রা নিধারণ করা হয়ে থাকে ডিভাইসের মাধ্যমে। সেখানে ভুল গণনা হলে রোগীর মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে।
ঝিনাইদহ জেলা ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিকুল করিম সোম বলেন, ব্রোকারদের কাছ থেকে ওষুধ নিতে আমরা সকল ফার্মেসি মালিকদের নিষেধ করি। হোলসেল মার্কেটের ওষুধের মানের কোন নিশ্চয়তা নেই। আবার সঠিক মাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণও করা হয় না। কাজেই সেই ওষুধ ব্যবহার করলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। অনেক ফার্মেসি মালিকের দোকানে তাপমাত্রা সংরক্ষণের সক্ষমতা নেই। বিশেষ করে গ্রামের দোকানগুলোতে। তবে সার্জিক্যাল ওষুধ বিক্রির দোকানগুলোতে অবশ্যই সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। হোল সেল ওষুধ বিক্রেতাদের জন্য ওষুধ বিক্রেতাদের অনেক বদনাম হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসনের এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সামনে মিলন সার্জিক্যাল এন্ড মেডিসিন যার প্রোপাইটার মো: মিলন, ড্রিম সার্জিক্যাল এন্ড মেডিসিন যার প্রোপাইটার মো: নাজমুল হাসান টিটন, মিডি রিলায়েন্স যার প্রোপাইটার মুন্তাসির রহমান পারভেজ (এই ফার্মেসীর ড্রাগ লাইসেন্স নেই), ইসলামী প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে মুন্সি সার্জিক্যাল এন্ড মেডিসিন যার প্রোপাইটার মোঃ শাহিনুর রহমান শাহিন, সরকারি কেসি কলেজ মার্কেটের দেশ ফার্মা যার প্রোপাইটার সুসান্ত কুমার কনক, শামীমা ক্লিনিক নিচে এর সুলতানা ফার্মেসি যার প্রোপাইটার শফিউদ্দিন, বঙ্গবন্ধু সড়কে মিতালী ফার্মেসি যার প্রোপাইটার রিয়াদ হোসেন, হামদহ মোল্লাপাড়ায় ইমরান ফার্মেসি ও ঝিনেদা মিটফোর্ড ফার্মেসির মালিক ইমরান হোসেন। এছাড়া খালেদা সার্জিক্যাল, মার্জিয়া ফার্মা, সার্জিক্যাল পয়েন্ট এন্ড মেডিসিন শপ সহ শহরের আনাচে কানাচে অনেক পাইকারি ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে। যাদের অনেকেরই ড্রাগ লাইসেন্স ও ওষুধ সংরক্ষণের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। বৈধ উপায়ে ব্যবসা করা কয়েকজন ফার্মেসি মালিক জানান, সরকারের ভ্যাট ফাঁকি দিতে ও বেশি লাভ করতে অনেকেই হোলসেলারদের কাছ থেকে ওষুধ নেয়। যার কোন পাকা মেমো নেই। কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের কোন তদারকি নেই। তারা মাসিক ভাবে এসব ফার্মেসি মালিক ও হোল সেলারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে। অনেক ওষুধের দোকান ওষুধ প্রশাসনের নীতি না মানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এছাড়াও লাইসেন্স প্রাপ্তী ও নবায়নের সময়ও ওষুধ তত্ত্ববধায়কের কার্যালয়ে ঘুষ প্রদান করতে হয়।
ঝিনাইদহ ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক সিরাজুম মনিরা বলেন, পাইকারী ওষুধ বিক্রি করে এমন দোকানের তালিকা দেন আমরা অভিযান পরিচালনা করবো। আমরা বিভিন্ন ক্লিনিকে মৃত্যুর ঘটনায় মেডিসিন পরীক্ষা করেছি। প্রায় সবগুলো কেচে এ্যানেস্থেসিয়ার সমস্যা পায়নি। অনেক সময় ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটে। এ্যানেস্থেসিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা ক্লিনিকগুলোতে অপারেশনের সময় এ্যানেস্থেসিয়া রাখার বাধ্যবাধকতার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু ক্লিনিকগুলো সেই নিয়ম মানে না। সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের চিঠি দিয়েছে। আমরা খুব দ্রুত এটি নিশ্চিৎ করতে মাঠে নামবো। এক ফার্মেসি মালিক জানিয়েছেন, ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক নিষিদ্ধ ওষুধও রোগীর ব্যবস্থা পত্রে লিখছেন ডাক্তাররা। এতে করে অনেক ফার্মেসি অননুমোদিত ওষুধও রাখছেন। তিনি বলেন, একই গ্রুপের ওষুধ এক কোম্পানি দাম ৩০ টাকা আবার আরেক কোম্পানি দাম ৩ টাকা। দুই ওষুধের মানই এক, দুই ওষুধের অনুমোদনই ওষুধ প্রশাসন দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করার আছে। ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল ওষুধ ঠেকাতে দরকার নিয়মিত জোর তদারিক।
ফার্মাসিটিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ অ্যাসোসিয়েশন ঝিনাইদহ জেলা শাখার সভাপতি সাইফুল ইসলাম মিলন বলেন, ঝিনাইদহে যে সমস্ত পাইকারি মেডিসিনের দোকান আছে তারা মূলত ঝিনাইদহে কর্মরত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মেডিসিন খুব একটা ক্রয় করেন না। যেগুলো মিটফোর্ডে পাওয়া যায় না সেইগুলোই আমাদের কাছ থেকে ইনভাইসের মাধ্যমে ক্রয় করে থাকেন। বেশি লাভের আশায় ঢাকার মিটফোর্ড মার্কেট ও অন্যান্য বিভিন্ন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে ঔষুধ ক্রয় করে থাকেন এই সমস্ত অসাধু বেশি মুনাফা লোভি ব্যবসায়ীরা। মূলত ভেজাল ও নকল ঔষধ লোকাল মার্কেটে ছড়িয়ে যায় এই সমস্ত পাইকারি মেডিসিন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দেখভাল করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।