প্রতিবছর পৃথিবীর নানা দেশ তাদের ভালো কাজগুলোর স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অপেক্ষা করে। সেইসব ভালো ও কার্যকর আবিস্কার ও সামাজিক কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে নানা পৃষ্ঠপোষকতাও করে। এটি এক অনন্য সম্মান। সেই সম্মান বাংলাদেশের ঘরে আসার পরেও হোঁচট খেয়েছিলো।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছিলো ড. ইউনুসকে নিয়ে। নোবেল পেয়ে তিনি নিজেকে তার যোগ্য করে প্রকাশ করতে না পেরে পরিচিতি পেয়েছিলেন নেতিবাচক নানা তকমায়। ২০০৭ সাল সেটাকে ত্বরান্বিত করেছিলো। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের সময়টা ছিলো কালো অধ্যায়। একদল মানুষ রাজনীতিতে সংস্কার আনার নামে দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলো প্রধান দুই দলকে নিস্ক্রিয় করার মাধ্যমে। সেই সময়টাকে স্বর্ণমুহুর্ত হিসেবে লুফে নেন ড. ইউনুস তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিতে। ঘোষণা দেন – তার নেতৃত্বে নতুন এক রাজনৈতিক দল হবে, যার নাম হবে নাগরিক শক্তি।
বেশিদিন সময় নেননি তিনি। নোবেল পুরষ্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কার্যক্রম শুরু করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। সেসব দিন আমরা যারা ভুলে গেছি তারা আরেকবার স্মরণ করি এই মানুষটির শিখরে ওঠার আকাঙ্ক্ষাকে।
শোনা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষার জায়গা এতোই প্রকট ছিলো যে ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার আগে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সেটিও তিনি ফিরিয়ে দেন। কোন সৎ উদ্দেশ্য থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন নয়। কেনো করেছিলেন এমন? হিসেব ছিলো পরিস্কার। স্বল্প মেয়াদী সরকার হওয়ায় কেয়ারটেকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হননি ড. ইউনূস। তার স্বপ্ন ছিল দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা। আর এ জন্য ‘নাগরিক শক্তি’ নামে নতুন দল গঠনও করেছিলেন।
তারপর কী হলো? সেই দল কোথায় গেলো। তার উদ্দেশ্য যে সৎ ছিলো না তা নাগরিক শক্তির ঘোষণা ও সাগরিক শক্তি না করার ঘোষণা দুটো থেকেই স্পষ্ট হয়। চলুন পিছনে ফিরে যাই। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ভারত সফরে যান। সে সফরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবার জোরালো সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ৩১শে জানুয়ারি দিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দেশের পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন। দেশকে উদ্ধারের প্রকল্প নিয়ে হাজির হওয়া ইউনুস বলেছিলেন, রাজনীতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার মতো ব্যক্তি আমি নই। কিন্তু পরিস্থিতি যদি বাধ্য করে তাহলে রাজনীতিতে যোগ দিতে আমি দ্বিধা করবো না।
নাগরিক শক্তির মৃত্যু ঘটেছিলো ইউনুসের হাত ধরেই। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা কিংবা বিদেশে পাঠিয়ে দেবার নানা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাপক ইউনূস সে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন মাত্র। তিনি ঘোষণা দিয়েও সামাল দিতে পারেননি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না। সে পরিস্থিতিতে ডঃ ইউনুস নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যান।
অনেকের সঙ্গে দল নিয়ে আলাপ করলেও তিনি গ্রীনসিগন্যাল পাননি। ফলে ২০০৭ সালের ৩রা মে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। রাজনীতিতে আসার জন্য তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার তিনমাসের মধ্যেই সে প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এবং তার সেই নাটকের জবনিকাপাত ঘটেছিলো আবারও একটি খোলা চিঠি দিয়েই। এজন্য তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে সে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, “যাদেরকে সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো তাদের আমি পাচ্ছি না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন তারা দল ছেড়ে আসবেন না। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ পথে অগ্রসর না হওয়াই সঠিক হবে মনে করে এ প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এই যে রাজনৈতিক দল করার আকাঙ্ক্ষা এবং যথেষ্ট সাড়া না পেয়ে পিছিয়ে পড়া সেখানো কোথাও ড. ইউনুস নিজেকে সমালোচনা করেননি। তার মতো একজন ব্যক্তির সেটাই করার কথা ছিলো। কেনো তিনি যথেষ্ট সাড়া পেলেন না সেখানেও তিনি কখনওই নিজের কমতি দেখতে পাননি। সবসময়েই তিনি অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলেছেন। কখনও দোষ জনগনের, যারা তার উদ্দেশ্য বুঝতে অক্ষম ছিলো, কখনও দোষ মাঠের রাজনীতিবিদদের, যারা তার ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে রাজি হননি, কখনও দোষ সময়ের, যে সময়ে ‘ফাঁকা মাঠেও’ তিনি গোল দিতে পারেননি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।