ইউরোপ, আমেরিকায় যখন তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার নানামুখি বাধার মুখে পড়ছে, ঠিক তখন আশার আলো দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দেশে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চীন, জামান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। এটা দেশের পোশাক শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় এবং দারুণ আশার খবর। নতুন এই বাজারগুলোতে বলা হয়ে থাকে অপ্রচলিত বাজার। এর কারণ এসব বাজারে ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডার মত ব্যাপকহারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়না। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের নতুন বাজারে অবশ্যই জোরালো ও তৎপরতা চালাতে হবে। যাতে করে নতুন এসব বাজার বাংলাদেশের পোশাকের দখলে আসে। নিশ্চয়ই তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এবং সরকার নিয়ে ভাবছে। যদি তৈরি পোশাকের নতুন বাজার সৃষ্টি করা যায় এবং যেসব দেশে ইতিমধ্যে নতুন করে বাজার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে ধরে রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রচলিত বাজার অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর উপর অতি নির্ভরতা কমিয়ে আনা যাবে।
বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। এই অবস্থায় কোনো কোনো বিশেষ দেশের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নতুন বাজার খুঁজে বের করা দেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাতের জন্য জরুরি বলে মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে দশ হাজার কোটি ডলার। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)তথ্য অনুযায়ি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারে ৮দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যা ২০২২ অর্থবছরের ৬দশমিক৩৭ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৩১.৩৮% বেশি। এটি আশার কথা। তবে তৈরি পোশাক রপ্তারিন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে পৌঁছাতে হলে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। সেজন্যই নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা এবং সেগুলোকে ধরে রাখার জন্য কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। আশার কথা হচ্ছে, এই যে অপ্রচলিত নতুন বাজার, তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের মোট ১৭.৮২% এসেছে কিন্তু সেই বাজার থেকে। অপ্রচলিত বাজার তৈরি পোশাক শিল্প থেকে একশ বিলিয়ন ডলার অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বিজিএমইএ বলছে, সেটা অর্জন করতে হলে অবশ্যই একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছা খুবই কঠিন কাজ হবে। যতদূর জানি বিজিএমইএ সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর কোন বিকল্পও নেই। কারণ ইউরোপ, অ্যামেরিকা বা ব্রিটেনে আমাদের তৈরি পোশাকের অর্ডার কমছে। তাই নতুন বাজার খুঁজে বের করা ও নতুন বাজারের চিন্তা করাটা খুবই জরুরি। সেই চিন্তা থেকেই মূলত জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো খুঁজে বের করেছেন বিজিএমইএ নেতারা। এসব দেশে এখন তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে এবং সেটা খুবই ইতিবাচক।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ি, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারে ৮দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ছিলো ৬দশমিক৩৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে ২০২৩ অর্থবছরে ৩১দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের মোট ১৭ দশমিক ৮২শতাংশ এসেছে অপ্রচলিত বাজার থেকে। আবার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকে মোট আয় হয়েছিল ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। আগের ছিলো অর্থবছরে এই আয় ছিলো ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০দশমিক ২৭শতাংশ বেশি।
আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আশার কথা হচ্ছে, অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের তিন দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।এই তিনটি দেশেই নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন বাজারের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে জাপানে ১৬০ কোটি ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় ১১৬ কোটি ডলার, ভারতে ১০১ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫৪ কোটি ডলার ও রাশিয়ায় ৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। সব মিলিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশের গন্তব্যই হচ্ছে এখন নতুন বাজার।
এই যে বাজার সৃষ্টি হলো এটিকে ধরে রাখতে অবশ্যই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদেরকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে পণ্যেল মান নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন নতুন সৃষ্টি হওয়া বাজার থেকে পণ্যের গুণগত মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠে। মনে রাখতে হবে, নতুন এই বাজার ঠিকটাক মতো ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে এই বাজারই হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ‘সোনার ডিম’ পাড়া হাঁসের মতো। সুতরাং এই বাজার ধরে রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ত্ব দিতে হবে। যদি কোনো কারণে কোয়ালিটি নিশ্চিতে কোনো রকম ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে নতুন বাজারের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিবে।
একই সঙ্গে এই বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাকেও টার্গেট করে এগুতে হবে। প্রতিযোগিতার বাজারে নতুন গন্তব্য খোঁজার কোনো বিকল্প নেই। সামনে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ আসবে। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে টালমাটাল করে দিচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশই আজ অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে। আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থায় ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা কানাডার মুখাপেক্ষি না থেকে সামনের দিনগুলোতে কিভাবে আরও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা যায় বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে সে লক্ষ্যে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। শুধু বিজিএমইএ নয়, সেসব দেশে বাংলাদেশের যে দূতাবাস আছে সেগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব সময় উদার ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
এখন বিজিএমইএ- কে আফিক্রা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলো যাচাইবাছাই করে সে সব বাজারে কী ধরনের পোশাকের চাহিদা বেশি, কোন মৌসুমে কী ধরনের পোশাকের চাহিদা এগুলো মাথায় রেখে বাজার সৃষ্টিতে মনোযোগি হতে হবে। তাহলেই আগামীতে এসব অপ্রচলিত বাজারের রপ্তানি আরও বাড়বে নিঃসন্দেহে।
আমরা যদি লাতিন আমেরিকার দিকে তাকাই তাহলে সেখানেও বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে মেক্সিকো, ব্রাজিলের মতো দেশ আমাদের তৈরি পোশাক নিচ্ছে। এই দুই দেশের পাশাপাশি লাতিনের অন্যদশেগুলোতেও তৎপরতা চালানো যেতে পারে নতুন বাজার সৃষ্টির। আমাদের ব্যবসায়ীরাও বলছেন, লাতিন আমেরিকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের জন্য একটি বড় বাজার। এর কারণ বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা তাদের ফ্যাশন ও স্টাইলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য সরবরাহ করতে পারে। এটা খুবই ইতিবাচক খবর। তাই ব্যবসায়ী ও সরকার উভয়েই যদি শক্ত হাতে লাতিনের এই বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন তাহলে লাতিনের দেশগুলো বাংলাদেশের বড় ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে আমার মনে হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৬২১দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৫১৫দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ১০৭দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার। লাতিন আমেরিকায় ২৫টির বেশি দেশের ৬৬ কোটি ভোক্তার বাজারকে দখলে নিতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। এ জন্য অবশ্য সরকারকেও আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। লাতিনের যেসব দেশের সঙ্গে এখনও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি সেগুরোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সেইসব দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে যেমন খুলতে হবে, তেমনি সেই সব দেশেও বাংলাদেশের দূতাবাস বা মিশন খুলে বাংলাদেশের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।