মেহেরপুর একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ।মেহেরপুরের বয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৫৮৯ সালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যশোরের প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য নদীপথেই মেহেরপুরের বাগোয়ানে আসেন।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়নের ভবানন্দ মজুমদার এই বিশাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা পরে নদীয়া রাজবংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমানের বলে চৌদ্দটি পরগনার রাজত্ব প্রাপ্ত হন তিনি।
এই মেহেরপুরে এসেছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খান। তিনি এসেছিলেন ভৈরব নদে বন্য পশুপাখী শিকার করতে।কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তিনি বিপদে পড়ে যান এবং রাজু গোয়ালানীর আতিথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হন। নবাব তার আপ্যায়নে খুশি হয়ে সমগ্র বাগোয়ান মৌজা তাকে দান করেন। নবাব তার পুত্রকে দেন রাজা উপাধি। রাজা গোয়ালা চৌধুরী মেহেরপুরের অনেক উন্নতি করেন। তিনি কৃষ্ণনগর থেকে সরাসরি মেহেরপুর পযন্ত সড়ক নির্মাণ করেন। কিন্তু এই সড়কই তার কাল হয়।এই পথে দিয়ে বর্গী দস্যুরা আসে এবং তাকে খুন করে তার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়।মেহেরপুরের এই ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়েই আজকের আলোচনা।
ইতিহাসের বইগুলো লেখা আছে, ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্দী খান মেহেরপুরের বাগোয়ান গ্রামের পাশে ভৈরব নদীপথে আসেন শিকার করতে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ফলে তিনি পরিষদসহ রাজু গোঁসাই নামীয় জনৈকা এক অখ্যাত বিধবা গোয়ালা রমণীর আতিথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হন। নবাব আলীবর্দী খান আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরস্থ সমগ্র বাগোয়ান মৌজা উক্ত মহিলাকে দান করেন। রাজু গোসাই মহিলার বহু গরু ছিল। আর এই কারণে গোচারণের জন্যই বাগোয়ানের সমগ্র এলাকা তথা মেহেরপুর প্রদান করেন। আলীবর্দী তার পুত্রকে দেন রাজা উপাধি। রাজা গোয়ালা চৌধুরী ক্রমেই হন মস্ত প্রভাবশালী। আলীবর্দীর সহায়তায় গোয়ালা চৌধুরীর সময়ে মেহেরপুর লাভ করে ব্যাপক উন্নতি।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্ন্দী খাঁ নদীপথে মৃগয়ায় আসেন এই বাগোয়ান পরগনায়। দুর্যোগ কবলিত হয়ে সপরিষদ আতিথ্য গ্রহণ করেন রাজু গোয়ালিনী নামের এক নামগোত্রহীন বিধবার। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব সেই বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, আর বিধবার পুত্র গোয়ালা চৌধুরী (মতান্তরে গোপাল) কে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজা গোয়ালা চৌধুরী এলাকার রাস্তাঘাটের যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি সাধন করেই পড়েন সংকটে। ঐ রাস্তা ধরেই বর্গি দুস্যুরা আসে মেহেরপুরে, লুণ্ঠন করে ধনসম্পদ, এমন কি ভূতলে আশ্রয়কক্ষ নির্মাণ করেও রক্ষা পাননি গোয়ালা চৌধুরী, বর্গিনেতা রঘুজী ভোসালার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।
এই ভূমির নামকরণ করা হয় রাজপুর। এই রাজা গোয়ালা চৌধুরী খেতাব প্রাপ্ত রাজুর পুত্র মেহেরপুর শহরের গোড়াপত্তন করেন।গোয়ালা চৌধুরীর আসল নাম ছিলো রাঘবেন্দ্র।
শ.ম. শওকত আলী কুষ্টিয়ার ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,‘রাজু গোঁসাইয়ের পুত্র গোয়ালা চৌধুরী নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি মেহেরপুরের যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। তিনি মেহেরপুরে একটি আটচালা শিবমন্দির এবং একটি কালীমন্দির নির্মাণ করে বেশ নাম করেন।
রাজা গোয়ালা চৌধুরী নদীয়া সদর কৃষ্ণনগর থেকে সরাসরি মেহেরপুর পযন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। এই সড়ক নির্মাণেই মেহেরপুরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বর্গী দস্যূরা মেহেরপুর আক্রমণ করে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। বর্গীদের অত্যাচার থেকে আত্নরক্ষার জন্য গোয়ালা চৌধুরীর বংশধররা ভূগর্ভে ইট দিয়ে গোপন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেন ও সমগ্র এলাকাকে ঘিরে পরীখা খনন করেন। মেহেরপুর পৌরসভার দক্ষিণে সেই ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কক্ষে তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া গেছে। এর বিলীয়মান বেশ কিছু বৃহত্তর তেঁতুল বৃক্ষ ঐ স্থানে ছিল। যে গাছ থেকে বর্গীদের আক্রমণ লক্ষ করে জনসাধারণকে সতর্ক দেয়া হতো। গোয়ালা চৌধুরী শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের কুখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুজী ভোসলার সাথে যুদ্ধে সপরিবাবে নির্মমভাবে নিহত হন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
মেহেরপুরের গৃহবধু কথাসাহিত্যিক নাসিমা আনিস কালি ও কলম পত্রিকায় ৩০জুন ২০১৬ খনন নামে আলীবর্দী খান ও রাজু গোয়ালিনীকে নিয়ে চমৎকার ইতিহাস নির্ভর গল্প লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,‘ বৃদ্ধ আলীবর্দী খাঁ মারাঠা নেতা রঘুজি ভোঁসালার সঙ্গে লড়তে-লড়তে সীমাহীন ক্লান্ত, শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন আপসরফায়। সেই সামান্য সুখের সময়ে আসেন মৃগয়ায়, এই বাগোয়ানের গহিন জঙ্গলে, গোটা তিনেক জাহাজ নিয়ে। জলঙ্গী নদী বয়ে সরস্বতী খাল হয়ে এই বিশাল ভৈরবে জাহাজ থামে। ফাল্গুনের মনোহর প্রকৃতি। বিশাল বাহিনী নিয়ে ভরা দুপুরে শিকার ধরার আশায় চারিদিক থেকে কেবল জমিয়ে এনেছেন শিকার। ঠিক তখন কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই গভীর অরণ্যে প্রবল শীলাবৃষ্টির কবলে পড়েন নবাব। নবাবের বেহাল অবস্থায় মাসিক আট টাকা বেতনের খেদমতগাররা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে খুঁজে পান জঙ্গলাকীর্ণ এক পরিত্যক্ত ভগ্নদশা প্রাসাদ। তাতে কয়েক ঘর জুড়ে স্বাস্থ্যবান গাভি আর বাছুর। সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে এক তরুণী কি যুবতী বিধবা, এক কিশোর পুত্রসহ ভয়ে কাঁপছেন। ভাবনা ছিল, নির্ঘাত মারাঠাদের আক্রমণ!
মাতাপুত্র আশ্বস্ত হলে নবাবকে আপ্যায়নে লেগে পড়েন রাজু গোয়ালিনী। প্রথমে দেন তাঁর বানানো দই, ছানার সন্দেশ আর ক্ষীর। এতদঞ্চলে রাজু গোয়ালিনীর দই-সন্দেশ আর ক্ষীর বিখ্যাত। দরিদ্রলোক এর আস্বাদ পেত না, পেতেন কেবল বাগোয়ান পরগনার জমিদাররা। বিকেলে পাতে দিলেন ঘি-মিশ্রিত অন্ন আর ঘরের ছাগলের মাংস। সজনেডাঁটা আর চালকুমড়ার বড়ির অপূর্ব ঝোল। নবাবের মুখে অনাস্বাদিত স্বাদ! এসব যে খাবার, এখানে না এলে তিনি জীবনে জানতেই পারতেন না! শেষ পাতে আবার মিষ্টান্ন। নিজ হাতে তিনি খাবার পরিবেশন করলেন, আতিথেয়তা যাকে বলে! রাজু সৌন্দর্যে যেমন অপরূপা, তেমনি গুণেও তুলনারহিত। গোত্রহীন এই বিধবা, খুবসম্ভব স্বামীর সহমরণের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিলেন এখানে শিশুপুত্র কোলে। পরিত্যক্ত সাপখোপ-সমৃদ্ধ জঙ্গল-মহল নিজগুণেই গড়ে তুলেছেন স্বর্গ। কোথা থেকে একটি গাভি পেয়েছিলেন, গোপনে বাপেরই পাঠানো কিনা, কিংবা কোনো জমিদার (!) কে জানে, এক-দুটি গাভি থেকেই হয়তো তাঁকে ঘর ভরিয়ে দিয়েছে ঈশ্বর!
আতিথেয়তায় মুগ্ধ এই নবাব বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, পুত্রকে উপহার দেন রাজা উপাধি। রাজা গোপাল চৌধুরী বড় হয়ে রাস্তাঘাট তৈরি করেন জনগণের খেদমতে। এতেই পড়েন মহাসংকটে! কিন্তু মায়ের মতো তিনিও সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন, বাঁচার মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন বইকি! কাঁটার ভয়ে গোলাপকে হেলা করতে শেখেননি যে একেবারে!’
এ প্রসঙ্গে ১৩১৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘নদীয়া কাহিনী ’ গ্রন্থে কুমুদনাথ মল্লিক লিখেছেন.‘বহু পূর্ব্বে মেহেরপুরে গোয়ালা চৌধুরী উপাধী-ভূষিত সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিগণ বাস করিতেন; ইঁহাদের প্রধান ছিলেন রাজা রাঘবেন্দ্র ও রাজুঘোষাণী (ইহার নাম হইতে রাজপুর পরগণার নাম হইয়াছে।) তাঁহাদের স্বাক্ষরিত সনদ, কোবালা , দানপত্র প্রভৃতি দলিলাদি অনেক গৃহস্থের ঘরে আছে। কথিত আছে বর্গীর হাঙ্গামাকালে মহারাষ্ট্রগণের অন্যতম নেতা রঘুজি ভোঁসালার সহিত যুদ্ধে এই বংশীয়েরা সপরিবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েন। চৌধুরীদিগের নিধনের পর বহুদিন তাঁহাদের অধিকৃত মেহেরপুরের অন্তর্গত প্রাসাদোপম অট্টালিকাদি ক্রোশৈকদূরস্থ সুবিস্তীর্ণ গড়ভূমি, দীর্ঘিকা ইত্যাদি বনাকীর্ণ হইয়া ছিল, এবং প্রয়োজন হইলেও কেহ কখন ইহার ইষ্টকাদি ব্যবহার করিত না। সাধারণের মনে ইহাই দৃঢ় সংস্কার ছিল যে, চৌধুরী বংশের ইষ্টকাদি লইলে কাহারও শুভ হয় না।’
এ সময় বিখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুনাথ ঘোষালির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গোয়ালা চৌধুরী নিহত হলে মেহেরপুর অঞ্চল রানী ভবানীর জমিদারীভুক্ত হয়। রানী ভবানী নিহত হলে কাসিম বাজার অঞ্চলটি ক্রয় করেন হরিনাথ কুমার নন্দী। পরে হাত বদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারীভুক্ত হয়। এক সময় মথুরানাথ মুখার্জির সঙ্গে কুখ্যাত নীলকর জেমস হিলের বিরোধ হয়। অথচ মথুরানাথের ছেলে চন্দ্র মোহনই বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেয়। বর্তমানে মূল ভবন ছাড়াও জেলখানা, মৃত্যুকূপ ও ঘোড়ার ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়।
মেহেরপুরের আমদহ গ্রামে গোয়ালা চৌধুরীর ধ্বংসাবশেষ ভবন পড়ে রয়েছে।মেহেরপুর শহর থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত আমদহ গ্রামে এই স্থাপত্য কীর্তি গোয়ালা চৌধুরীর কথা বলে।প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই প্রত্নস্থানের চারিদিকে ছিল পরিখা, কিন্তু পরিখার বেষ্টনীতে কোন প্রাচীর ছিল না। মাসিক পত্রিকা সাধক এর ১৩২০ (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে,আমদহ গ্রামের এই স্থাপত্য শৈলীর ধ্বংসাবশেষকে রাজা গোয়ালা চৌধুরীর সঙ্গে বগা দস্যুদের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত আবাসস্থল।
ভ্রমণ গাইড পত্রিকায় আমদহ গ্রামের স্থাপত্য সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘প্রাচীন নোনা ধরা দেয়াল, আর তাতে ঝুলন্ত গাছের ঝুরি, উন্মুক্ত সদর দরজা বহু আগেই তার জৌলুস হারিয়েছে, ঝুল বারান্দাটায় এখন ও গাছের ফাক গলে রোদ্দুর খেলা করে ঠিক যেমন করত শতবর্ষ আগে। চৌকাঠ এবং ছাদের কড়ি বরগাগুলো যেন বয়সের ভারে ক্ষান্ত দিয়েছে এবার। সাবেকী আমলের লাল ইটের পোড়ামাটির দালান আর মোটা স্তম্ভগুলো যুগের পর যুগ টিকে আছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। বলা হচ্ছে দেশের ক্ষুদ্রতম জেলা মেহেরপুরের আমদহ গ্রামে অবস্থিত এক প্রাচীন স্থাপত্যের কথা।’
আমদহ গ্রামের স্থাপত্য স্থলের মাটির নীচ থেকে প্রাপ্ত একটি প্রত্মতত্ব স্তম্ভ পুরাতন জেলা প্রশাসকের ভবনের সামনে স্থাপিত রয়েছে।
নবাব আলীবর্দী খানের মেহেরপুরে আগমন, রাজু গোয়ালানীর আপ্যায়ন,গোয়ালা চৌধুরী কর্তৃক মেহেরপুরের উন্নয়ন এবং বর্গী দস্যুদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাটি মেহেরপুরের ইতিহাসের একটি বিশাল ঘটনা। এই ধরণের অনেক ঘটনা রয়েছে মেহেরপুরের ইতিহাসে। এই সব ঘটনা অনেকেরই জানা নেই। আসুন ইতিহাসের এই সব ঘটনা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি এবং মেহেরপুরের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করি।
তথ্যসূত্রঃ
১।কুমুদনাথ মল্লিক ‘নদীয়া কাহিনী ১৩১৭ বঙ্গাব্দ
২।শ.ম. শওকত আলী কুষ্টিয়ার ইতিহাস
৩।মাসিক পত্রিকা সাধক এর ১৩২০ (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা)
৪।কালি ও কলম পত্রিকা ৩০জুন ২০১৬
৫।ভ্রমণ গাইড অনলাইনপত্রিকা
৬। ইন্টারনেট থেকে
মুহম্মদ রবীউল আলম: লেখক-সাংবাদিক, মেহেরপুরের কৃতী সন্তান।
ছবি-মেহেরপুরের আমদহ গ্রামে গোয়ালা চৌধুরীর ধ্বংসাবশেষ ভবন