অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
আজ সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোর ৫টা ৫ মিনিটে কাতার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সফরসঙ্গীদের নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূসের এটাই প্রথম বিদেশ সফর। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর বক্তৃতা করবেন।
এর আগে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে দায়িত্ব পালন করা নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ এবার নতুন রূপে হাজির হচ্ছেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে সেখানে গণতন্ত্র ও শান্তির বার্তা নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দ্বিতীয় বিজয়ের নতুন যাত্রায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, ড. ইউনূসের বক্তব্যে সেসব তুলে ধরা হবে। বিশ্ববরেণ্য এই গুণী ব্যাক্তিকে বরণে অনেক দেশের সরকারপ্রধান ও উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরাও অধীর আগ্রহে রয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা ৭৯তম অধিবেশনের ভাষণে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তার আগে অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে যাচ্ছেন। গত তিন দশকে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে এমন বৈঠক এবারই প্রথম। সবকিছু ঠিক থাকলে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা এ বৈঠকে বসবেন।
জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একসময় শিক্ষকতা পেশায় থাকা ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ওই ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বিশ্বব্যাপী দ্যুতি ছড়িয়েছেন অনেক আগেই। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ড. ইউনূসের নাম। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাস্কিয়া ব্রুইস্টেন, সোফি আইজেনম্যান এবং হ্যান্স রাইটজের সঙ্গে একত্রে সামাজিক ব্যবসা—গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভস প্রতিষ্ঠা করেন। ড. ইউনূসের নতুন, মানবিক পুঁজিবাদের দৃষ্টিভঙ্গির আন্তর্জাতিক বাস্তবায়ন শাখা হিসেবে এই সামাজিক ব্যবসা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক ব্যবসার জন্য ইনকিউবেটর তহবিল পরিচালনা করে এবং কোম্পানি, সরকার, ফাউন্ডেশন এবং এনজিওদের পরামর্শ সেবা দেয়। ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে ১৯৮৪ সালে র্যামন ম্যাগসেসে, ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার পান তিনি। ২০০৪ সালে ফিলাডেলফিয়ার হোয়ার্টন স্কুল অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া তাকে গত ২৫ বছরে ২৫ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক ব্যক্তির মধ্যে একজন হিসেবে নির্বাচন করে। ২০০৬ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। একই বছর টাইম ম্যাগাজিন তাকে শীর্ষ ১২ জন ব্যবসায়িক নেতার মধ্যে স্থান দেয় এবং ‘এশিয়ার ৬০ বছরের নায়ক’দের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের ‘প্রসপেক্ট ম্যাগাজিন’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলিসি’ পরিচালিত একটি উন্মুক্ত অনলাইন জরিপে শীর্ষ ১০০ জন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয় তাকে। ২০০৯ সালে ড. ইউনূস স্লোভাকিয়ার ইনফরমাল ইকোনমিক ফোরাম ইকোনমিক ক্লাবের দেওয়া সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন বিয়াটেক অ্যাওয়ার্ড পান। ২০২১ সালে ক্রীড়া উন্নয়নে তার বিস্তৃত কাজের জন্য অলিম্পিক লরেল পুরস্কার পান তিনি। ২০২১ সালে ড. ইউনূসকে ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ পুরস্কার দেওয়া হয়। মানব মর্যাদা, সমতা এবং ন্যায়বিচার বৃদ্ধির জন্য তার আলোকিত নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের মানবহিতৈষণা পুরস্কার, শ্রীলঙ্কার মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন বিজ্ঞান (সামাজিক অর্থনীতি) পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব খাদ্য ও শান্তি পুরস্কার, সুইজারল্যান্ডর ম্যাক্স সছমিধেইনি ফাউন্ডেশন ফ্রিডম পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিশিষ্ট অ্যালামনাই পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক অ্যাকটিভিটিস্ট পুরস্কার, জার্মানির প্লানেটরি কনশিয়াশনেস বিজনেস ইনোভেশন পুরস্কার, নরওয়ের হেল্প ফর সেলফ হেল্প পুরস্কার, ইতালির ম্যান ফর পিস অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব ফোরাম পুরস্কারসহ যুক্তরাজ্য, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফ্রান্স, জর্ডান, ভিয়েতনাম, সুইডেন, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পুরস্কার জমা হয় ড. ইউনূসের থলেতে। তিনিই মাত্র সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। ড. ইউনূস ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের কার্যক্রমকে সমর্থনকারী জনহিতকর সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদেও দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন তিনি।
সুত্রঃ কালবেলা