“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রীদের শেষ বৈঠক হয়েছে এবং তার ফলে শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিপর্যয় ঘটেনি বাঙালী হারিয়েছিলো তার স্বাধীনতা।’’
এই জনশ্রতি দিয়েই ঐতিহাসিক স্থাপনা আমঝুপির নীলকুঠির কালিমা লেপে ইতিহাস বিকৃতি করা হলো ১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ। তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান ভূইয়াঁর একটি ফলক নীলকুঠিতে স্থাপন করার পর থেকে এই নীলকুঠিসহ পুরোগ্রামটিকে ষড়যন্ত্রীদের অংশি হিসেবে ইতিহাসের কালো অধ্যায় রচনা করা হলো। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ইতিহাস বিকৃতি করে একটি বই লিখে তাকে সহযোগীতা করছিলেন লেখক আবুল আহসান চৌধুরী।
বিভিন্ন লেখকের বই থেকে জানা গেছে, ১৮১৮ থেকে ১৮২০ খৃস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে মেহেরপুরের আমঝুপি, ভাটপাড়া, কাথুলি, বামন্দীসহ বেশকিছু স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়।
ইতিহাস বলে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাপতি লর্ড ক্লাবের নেতৃত্বে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। পলাশীর যুদ্ধে কয়েকবছর পর লর্ড ক্লাইভ ইংল্যাণ্ডে ফিরে যান এবং ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর তিনি ইংল্যাণ্ডে আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু বিকৃত ইতিহাসে জনশ্রুতির দোহায় দিয়ে বলা হয়েছে, পলাশীর যুদ্ধের আগে মাঝে মধ্যে লর্ড ক্লাইভ আমঝুপি নীলকুঠিতে আসতেন এবং এই নীলকুঠিতে মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রের বৈঠক করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর নীল নকশা করেন। যে নীলকুঠি জন্ম হয় ১৮১৮ সালে অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের ৬১ বছর পর। সেই নীলকুঠিকে কিভাবে লর্ড ক্লাইভ-–মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের নীলনকশার বৈঠকখানা বলা হয় ?
নীলকুঠি কেন স্থাপন করা হয়
১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এ বঙ্গে কোম্পানী আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় মেহেরপুরসহ সমগ্র নদীয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাষনভুক্ত হয়। পরবর্তিতে ১৭৭৮ সালে ক্যারেল ব্লুম নামের এক ইংরেজ মেহেরপুর সহ বিভিন্ন স্থানে নীল চাষ শুরু করেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের ব্যবসায়ীক প্রসারের কারণে উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমঝুপি নীলকুঠিসহ বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ করে। ইংরেজ কুঠিয়াল কেনি, সিম্পসেন, ফার্গুসেনের সতীর্থদের অত্যাচার আর শোষণের স্থান ছিলো এই নীলকুঠি।
নীলকরদের অত্যাচার আর নির্যাতনের সাক্ষী আমঝুপি নীলকুঠি। কর পরিশোধ না করতে পারলে নীলচাষিদের উপর চলতো নানা নির্যাতন, এমনকি হত্যা করে লাশ মূত্যুকুপে নিক্ষেপ করে উল্লাস করা হতো। নীলকুঠিতে এখনো সে সকল নির্যাতনের স্মৃতি চিহৃ আকাশে বাতাসে বয়ে বেড়ায়। শুনশান নিরবতায় প্রাকৃতিক নির্জনতার প্রতিটি পরতে রয়েছে সে নির্যাতনের ক্ষত চিহৃ।
জানা যায়, অত্যধিক লাভজনক হওয়ায় ১৭৯৬ সালে মেহেরপুর অঞ্চলে নীল চাষ শুরু হয়। এ সময় বিখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুনাথ ঘোষালির সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে গোয়ালা চৌধুরী নিহত হলে মেহেরপুর অঞ্চলে রানী ভবানীর জমিদারীভুক্ত হয়। রানী ভবানী নিহত হলে কাসিম বাজার অঞ্চলটি ক্রয় করেন হরিনাথ কুমার নন্দী। পরে হাত বদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারীভুক্ত হয়। এক সময় মথুরানাথ মুখার্জির সঙ্গে কুখ্যাত নীলকর জেমস হিলের বিবাদ বাধে। মথুরানাথ-এর ছেলে চন্দ্র মোহন বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেন। চন্দ্র মোহনের ছেলে মহেষ মুখার্জি জেমস হিলের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ইতিহাসে ইনিই নীলদর্পণ নাটকে গুপে দেওয়ান নামে পরিচিত।
নীল গাছ পচা পানি জ্বালিয়ে তৈরি করা হতো নীল রঙ। এক বিঘা জমিতে আড়াই থেকে তিন কেজি নীল উৎপন্ন হতো- যা উৎপাদন করতে ব্যয় হতো ১২-১৪ টাকা। অথচ চাষীরা পেতো মাত্র তিন-চার টাকা। চাষীদের দাদন দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হতো যাতে তারা জমিতে নীল চাষ বাদি দিয়ে অন্য চাষ না করতে পারে। ফলে বলা হয়, নীল গাছ থেকে যে রঙ তৈরি করা হতো তা ছিল চাষীদের বুকের পুঞ্জ্ভিূত রক্ত। জমাটবাঁধা ক্ষোভে নীলচাষিরা আস্তে আস্তে আন্দোলন গড়ে তোলে। এক সময় দুর্বার আন্দোলনে নীলকররা আমঝুপি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
আমঝুপি নীলকুঠি নীলকরদের শত অত্যাচারের একটি ঐতিহাসিক স্থান। নীলকুঠিয়াল মিকেনী, সিম্পসন, ফার্গুসেন, জেমস হিল এদের আনন্দের হোলি আর কৃষকদের নির্যাতিত হওয়ার কাহিনী আমঝুপি নীলকুঠির আকাশে-বাতাসে এখনো জড়িয়ে আছে।
আমঝুপি বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে আধা কিলোমিটার পিচঢালা পথ যেতেই নীলকুঠির প্রধান ফটক দেখা যাবে। খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ডিসি ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগে নেওয়া হয় ২০১৮ সালের দিকে। সে সময় এই ফটকটি নির্মাণ করা হয়। ইকোপার্কের জন্য নীলকুঠির স্থাপনাগুলো কিছু সংস্কার করা হয়। তবে পার্কটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। প্রধান ফটক পেরিয়ে সড়ক বরাবর সেই নীলকরদের শোষণের স্মৃতিচিহৃ নীলকুঠি ভবন। ভবনের আগে সড়কের দুই পাশে আম ও লিচুর বাগান। ভবনের উত্তর দিকে কাজলা নদী। কাজলা নদীর সাথে ব্রীজের মাধ্যমে ভবনের সংযোগ রয়েছে। নীল উৎপাদন করতে প্রচুর পানি লাগতো এবং যোগাযোগ সহজ করার জন্য নীলকুঠিগুলো ইংরেজরা বানিয়েছিলো নদীর পাড়ে। নীলকুঠিতে পৌছালেই এক প্রাকৃতিক নির্জনতা লক্ষ্য করা যায়। নীলকুঠির বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের সেই নীল গাছ চোখে পড়ে। সারি সারি নারিকেল গাছ চোখ জুড়াবে। ভবনের উত্তর-পূর্ব দিকে দুটি বড় আকারের কড়ুই গাছ পুরো নীলকুঠির সৌন্দর্য্যকে আকড়ে ধরে রয়েছে। আম, লিচুসহ বিভিন্ন গাছে পাখিদের আনাগোনা বেশ। একটু কান পাতলেই পাখিদের ডাক শোনা যায়। কখনো কখনো মনে হয় নিজর্নতায় নীলচাষীদের করুণ আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে।
নীলকুঠির মূল ভবনে যা আছে
আমঝুপি নীলকুঠির মূল ভবনটি আয়তাকার আকৃতির। নদীপথের যাত্রার সুবিাধায় ভননটি কাজলা নদী মুখ করে উত্তরমুখী করা হয়। তবে বর্তমানে দক্ষিনমুখী হয়ে প্রবেশ করতে হয়। ভবনটিকে দুদিক থেকেই সামনের দিকে মনে হয়। ৩৭ মিটার দৈঘ্য এবং ২২ মিটার প্রস্থের এ ভবনটিতে ছোটবড় ১৩টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শয়ন কক্ষ, নাচঘর, স্নেকপ্রুফ কক্ষ, মৃত্যুকুপ। প্রচলিত আছে, ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্য নতর্কীদের নাচতে হতো। কোন প্রজা খাজনা কিংবা নীলচাষে অনীহা প্রকাশ করলে তাকে হত্যা করে মূত্যুকুপে নিক্ষেপ করা হতো। স্নেকপ্রুফ কক্ষটি এত মসৃণ যে সাপ কিংবা পিপড়া চলতে পারবে না। নীলকুঠিতে আরো রয়েছে পুরাতন রেকর্ড রুম, কয়েদখানা, কাচারী ঘর, নায়েবদের আবাসন।
১৯৭৮ সালে ভবনটিকে নতুন করে ৮২ লাখ টাকা খরচ করে সংস্কার করা হয় এবং পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এলাকার উন্নয়নের নাম করে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান ভ’ইয়া ১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ ওই বিকৃত ইতিহাসের ফলক লাগিয়ে দেন ভবনটিতে। পরবর্তিতে ২০১৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধিনে প্রথ্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নীলকুঠি মূলভবন সহ ৩ একর ৬১ শতক জমি অধিগ্রহণ করে। ভবনটির ভিতরে নতুন করে কিছু সংস্কার করা হয় এবং একটি জাদুঘর করা হয়। তবে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বাকি ৬১ একর জমি। পরিচর্যার অভাবে বাগানের জৌলুস হারাচ্ছে।
ঐতিহাসিক এ নীলকুঠিতে প্রায় প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা যান। বছরে প্রায় ২০ হাজার পর্যটক নীলকুঠি পরিদর্শন করেন। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নীলকুঠিকে প্রসারিত করতে হলে কিছু সুবিধা বাড়ানোর দাবী জানিয়েছেন তারা।
নীলকুঠি চত্বরে দীর্ঘদিন ধরে চায়ের টং দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন সামসুল হক মিলন। চা খেতে খেতে মিলনের সাথে কথা হয় নীলকুঠি সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে । মিলন বলেন, সপ্তাহে সাধারণত শুক্রবার ও শনিবার পর্যটক আসে। মহিলা পর্যটকদের জন্য অসুবিধা পড়তেই হয়। এখানে কোন টয়লেটের (ওয়াশরুম) ব্যবস্থা নেই। অনেকটা বাধ্য নীলকুঠির পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে তাদের সে ব্যবস্থা করতে হয়। মিলন আরো বলেন, ২০১৮ সালে সরকারিভাবে একটি টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পানির ব্যবস্থা না করতে পারায় সেটা নাকি উদ্বোধন করা গেল না।
মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও স্থানীয়রা বারবার আমঝুপি নীলকুঠির বিকৃতি ইতিহাসের ফলক মুছে সঠিক ইতিহাসে স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও সে ফলক রয়ে গেছে।
কিভাবে যাবেন আমঝুপি নীলকুঠি
ঢাকাসহ দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বাসযোগে মেহেরপুর জেলা শহওে আসতে হবে। জেলা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান। জেলা শহর থেকে রিক্সা বা ইজিবাইকে করে খুব সহজেই যেতে পারবেন নীলকুঠিতে। সপ্তাহে প্রতি রবিবার পূর্নদিবস এবং সোমবার দুপুর ২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে নীলকুঠির মূলভবন। অন্যান্য দিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ১০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে ঘুরে দেখতে পারবেন ঐতিহাসিক নীলকুঠি ভবনটি।