পদ্মা সেতু খুলে দেওয়াকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত মেহেরপুরের কৃষক ও কৃষির সাথে জড়িত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। সেতু চালু হওয়ার পর এ জেলার কৃষিক্ষেত্রে আনবে কৃষি বিপ্লব। জেলার কৃষক ও কৃষি পণ্য ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মেচিত হবে।
কৃষি সমৃদ্ধ জেলা মেহেরপুর থেকে সহজেই ঢাকা পৌঁছে যাবে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক। সারাদেশের সঙ্গে বিশেষ করে চিটাগাং সিলেটসহ দ্রুত যোগাযোগ হবে। আর ওই সব অঞ্চলের মানুষের সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে। ভাল যোগাযোগের ফলে মেহেরপুর বাসির ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুলবে নতুন দুয়ার। উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হবে জেলার মানুষ। জেলাবাসির জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। এছাড়াও পদ্মা সেতুর কারণে দির্ঘদিনের আরিচা ঘাটের জ্যাম থেকেও মুক্তি পাবে এ এলাকার মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মেহেরপুর জেলার জেলার কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী লাভবান হবে কৃষি ও পরিবহন খাত।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের মেহেরপুর জেলার শাখার সভাপতি প্রফেসর হাসানুজ্জামান মালেক বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে অভাবনীয় সাফল্য। মেহেরপুর জেলা থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সাথেই সরাসরি বাড়বে যোগাযোগ। ফলে ঢাকা, চিটাগাং, সিলেটসহ অন্যান্য জেলার ক্রেতারা এ জেলার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কৃষি পণ্য কিনবেন। যার ফলে কৃষকরা লাভবান হবেন আগের তুলনায় বেশী। এক শ্রেনীর মধ্যস্বত্বভোগীরা আমাদের কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে নিয়ে যায়। যখন কৃষকরা সরাসরি মুল কৃষি মার্কেটের সাথে সম্পৃক্ত হবেন তখন তারা দামটাও ভাল পাবেন। তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হবে মেহেরপুর জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। মানুষের জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। তিনি বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা সরাসরি কাঁচা মাল কিনে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন। এর ফলে আমাদের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা ভোগ করছেন কৃষকের উৎপাদিত ফসলের লাভ। পদ্মা সেতু চাল হলে কৃষকরা যেমন লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন। বিশেষ করে কৃষকরা ইচ্ছে করলে নিজেরাই খুব সহজেই দেশের বড় বড় মার্কেটগুলোতে নিজেদের সব্জী বিক্রি করতে পারবেন।
মেহেরপুর ট্রাক মালিক গ্রুপের সভাপতি আলহাজ্ব গোলাম রসুল বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে জেলার মানুষের ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলবে। এটা আমাদের জন্য শুভ লক্ষণ। যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ হলে এলাকার সব্জী ফসল সঠিক সময়ে ঢাকা, চিটাগাংসহ অন্যান্য জেলাতে দ্রুত পৌছে যাবে। তিনি বলেন, এতদিন ফেরি পারাপার হয়ে ঢাকায় যেতে পাটুরিয়া ঘাটে জ্যামে পড়ে দিনের পর দিন সেখানে অপেক্ষা করতে হতো। সব্জী পচে যাওয়ায় অনেক সময় কৃষক বা ফঁড়িয়া ব্যবসায়ীরা আমাদের ট্রাকের ভাড়া দিতে চাইতো না। ফেরি পারাপারে দেরী হওয়ার ফলে সঠিক সময়ে তারা বাজার ধরতে পারতো না। তাই ব্যবসায়ীরা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্থ হতেন। পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু কৃষকরাই নয় আর্থিকভাবে পরিবহণ ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন।
মেহেরপুর তহবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহা: হানিফ উদ্দীন বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের জেলার কৃষকদের জন্য নতুন দিগন্তের দার খুলবে। আমরা এতদিন কাঁচামাল নিয়ে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে যে জ্যামের শিকার হতাম, সেটা দুর হবে। সেতুটি খুলে দেওয়ার সাথে সাথে যশোর, বেনাপোল, খুলনাসহ ওই এলাকার গাড়িগুলো সরাসরি সেতু হয়ে যাবে। তখন পাটুরিয়া ঘাটে জ্যামটাও কেটে যাবে। আমাদের গাড়িগুলোর ফেরি সুবিধাও বাড়বে এছাড়া আমরা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকা চিটাগাং, সিলেট বা অন্যান্য জেলাতে কৃষি পণ্যগুলো নিয়ে যেতে পারবো। তিনি বলেন মেহেরপুর জেলা থেকে সাধারণত, কাঁচা মরিচ, সীম, বেগুন, আলু, পটল, কচু, শসা, আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি যায়। সেতুটির কারণে আমাদের জেলার মানুষ সরাসরি এবং সহজেই ঢাকাতে পৌছাতে পারবে।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের সব্জি চাষী মহিবুল ইসলাম ও তহসেন আলী বলেন, সারা বছরই এ গ্রামের কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের সব্জি, তরমুজ ও বিভিন্ন ধরণের কৃষিপণ্য উৎপাদন করে থাকেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকার কারণে এতদিন মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি ছিলেন এলাকার শত শত সব্জী চাষী। তারা বলেন, পাইকাররা আমাদের জমি থেকেই সরাসরি সব্জিসহ অন্যান্য ফসল কিনে নিয়ে যেতো। তাতে আমাদের লাভ কম হতো। নিজেরা ঢাকাতে সব্জী নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেও ফেরি ঘাটের জ্যামের কারণে অনেক সময় সব্জী নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতো। যে কারণে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাননা। পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের ফসল আমরা নিজেরাই ঢাকা শহর বা চিটাগাং ও সিলেটে নিয়ে যাবো। মাঠে ফসল ফলাই আমরা সাধারণ কৃষক আর মাঝখানে লাভ করে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীরা।
মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন বলেন, পদ্ম সেতু সারা বাংলাদেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় দিগন্ত উন্মেচন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পদ্মা সেতুর কারণে, মেহেরপুরের সব্জি, ধান, পাটসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সহজেই যুক্ত হবে জাতীয় অর্থনীতির সাথে। ফলে মেহেরপুর জেলার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে।
তিনি বলেন, মেহেরপুরে রয়েছে ফসল চাষের বিস্তীর্ণ জমি। শাকসবজি ও আম, কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য এসব জমি খুব উপযোগী। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত হবে। যে কারণে ফসলের পচনশীলতা হ্রাস পাবে। কৃষকরা ভাল লাভ পেলে বিভিন্ন শাকসবজি এবং বিশেষ করে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপাদন বাড়বে জেলায়। এতদিন উৎপাদিত পণ্য বিপণনের দুর্ভোগ ছিল। এসব কারণে ওই অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা অপেক্ষাকৃত কম। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের অভিপ্রায় সফল হবে। নতুন প্রযুক্তি ধারণ ত্বরান্বিত হবে। দ্রুত বেড়ে যাবে শস্যের উৎপাদন। গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। তাতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, বাড়বে আয়। এ জেলায় পাটচাষেও কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন। গড়ে উঠবে পাটভিত্তিক শিল্প কলকারখানাও।
সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন প্রধান মন্ত্রীর কাছে দাবী করেন, পদ্মা সেতুর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের। দৌলতদিয়া পাটুরিয়া ঘাটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে রাজবাড়ি, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরার যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধমে উন্নিত সাধিত হবে।