এম এফ রুপক:
আল হাসিব। মেহেরপুর সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের মুদি দোকানদার বিল্লাল হোসেন এর ছেলে। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে লেখাপড়া বেশি করতে পারেনি। বাবার ব্যবসার অবস্থাও তেমন ভালো না। নিজে চেষ্টা করেছেন গার্মেন্টস এর দোকন দিতে সেখানেও ব্যার্থ হয়েছেন। ইউটিউবে পাতি হাস পালনের প্রামান্য চিত্র দেখে অনুপ্রানিত হয় হাসিব। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের পাশে ছোট্ট টিনের ঘর তৈরি করে প্রথম অবস্থায় ২০টি পাতিহাঁস পালন শুরু করে। পরবর্তিতে পরিবারের সহায়তায় আরও ৫০টি হাসের বাচ্চা কিনে পালন শুরু করে। বর্তমানে হাসিবের হাঁসের সংখ্যা প্রায় ৮শ। দেড় বছরে পাতিহাঁস পালনে বাজিমাত করেছেন ২৪ বছরের এই তরুন। বিশেষ কায়দায় ভৈরবের কিছু অংশ ঘিরে চালিয়ে যাচ্ছেন হাস পালন। মাস শেষে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ বাদে উপার্জন হয় তার।
স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে হাসিব বলেন, ইউটিউববে দেখে অনুপ্রানিত হই। তারপর ভৈরবের ধারে হাস পালন শুরু করি। ডিম ও মাংসের চাহিদা বেশি থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে বেশ সফল হয়েছি। বর্তমানে আমার খামারেই ইনকিউবেটরের সাহায্যে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজও হয়। প্রতিদিন প্রায় ৪শ ডিম সংগ্রহ করতে পারি। এছাড়াও হাঁসের বাচ্চা কিনতেও আসে আমার খামারে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ভৈরবের ধারে হওয়ায় খাবারও কম লাগে।
রাজাপুর গ্রামের আব্দুর রহমান নামের এক চা দোকানি ভৈরবের ধারে গড়ে তুলেছেন হাসের খামার। চা বিক্রির পাশাপাশি আব্দুর রহমান ও তার স্ত্রী ইসমত আরা মিলে পালন করছে পাতিহাঁস। দুজনের চেষ্টায় হাস পালনে বেশ স্বাবলম্বী তাদের পরিবার। তাদের খামারে রয়েছে প্রায় ৪শ পাতি হাস। পাশাপাশি রয়েছে ১০টি রাজা হাস। মাংস ও ডিম বিক্রি করে খরচ বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন হয়। প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ৮ টাকা দর ও মাংস বিক্রি হয় ১৮০ টাকা কেজি দরে।
ইসমত আরা জানান, চা বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। কোন উপায় না পেয়ে আমরা দুজনে মিলে পাতিহাঁস পালন শুরু করি। প্রথম অবস্থায় ১০টি ডিম দেওয়া হাঁস কিনি। তারপর একটি এনজিও থেকে লোন করে ভৈরবের ধারে হাঁস পালনের জন্য খামার তৈরি করে ১শ মত হাস কিনে পালন শুরু করি। বছর না পেরোতেই বাচ্চাসহ বর্তমানে আমার হাসের সংখ্যা প্রায় ৪শ।
প্রদিপ্ত সাহা সজল। মেহেরপুর শহরের হালদার পাড়ার সুদিপ্ত সাহার ছেলে। মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে অর্নাস শেষ করেছেন। চাকরির পিছনে না ছুটে রাধাকান্তপুর সংলগ্ন ভৈরবের ধারে গড়ে তুলেছেন পাতিহাঁসের খামার। সজলের খামারে রয়েছে ২ হাজার পাতি হাস। দুই বছরের পরিশ্রমে এখন প্রতি মাসে প্রায় ২ লাখ টাকা আয় হয় তার। নিজের খামারে ডিম উৎপাদনের পাশাপাশি মাংস ও বাচ্চা উৎপাদনও করছেন।
সজল জানান, পাতিহাস পালনে তেমন একটা খরচ হয় না। এদের রোগ বালাই কম। সকালে ভৈরব নদে ছেড়ে দেওয়া হয়, বিকালে আবার নিজেরাই খামারে ফিরে আসে। সারা দিন ভৈরব নদে চরে বেড়ায়। তাই বাইরে থেকে খুব কম খাবার দিতে হয়। কিছু দিন আগে ১ হাজার হাঁস বিক্রি করেছি। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় থেকে ২৫০ টাকা পিচ দরে কিনে নিয়ে গেছে এক খামারের মালিক।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর। এই জেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। এই নদকে কেন্দ্র করে দুপাশে বেশ কিছু পরিবার এভাবেই গড়ে তুলেছে পাতিহাঁসের খামার। বেকার যুবকরাও হাস পালন করে বেশ স্বাবলম্বী হচ্ছে। বাজারে মাংস ও ডিমের বেশ চাহিদা। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়ার বাজারে বিক্রি হচ্ছে হাসের ডিম ও মাংস। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেহেরপুরে আসছেন হাসের বাচ্চা ও ডিম কিনতে।
পাতিহাঁস পালন করে স্বালম্বী হয়েছেন গাংনী উপজেলার ৭০ বছরের বৃদ্ধ সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৩০টি হাঁস নিয়ে ছোট একটি খামার তৈরি করি। সে সময় বয়স ও দারিদ্রতার কারনে তেমন কিছু করার সামর্থ্যও ছিল না। বর্তমান খামারের প্রায় ৭শটির মত হাঁস আছে। প্রতিদিন ২শ থেকে ২৫০টি হাঁসের ডিম সংগ্রহ করি। প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ৭-৮ টাকায়।
মুজিবনগর উপজেলার বিদ্যাধরপুর গ্রামের আশরাফুল ও সাদেক আলী দুজনে মিলে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। বিদ্যাধরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের কিনারাই তাদের ১০ কাঠা জমি জুড়ে এই খামার। ১ হাজার পাতিহাঁস আছে খামারে। সাদেক আলী জানান, ১২শ হাসের বাচ্চা কিনে শুরু দুজন মিলে শুরু করেছিলাম। বর্তমানে ১ হাজার টিকে আছে। এখনো সব গুলো ডিম দেওয়া শুরু করেনি। তবে আশা করছি ৫শ হাঁস ডিম দেবে।
মেহেরপুর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, বর্তমানে গরু ছাগল পালনের পাশাপাশি হাস-মুরগী পালনেও বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে হাসের খামার গড়ে উঠেছে অনেক। মেহেরপুরের জন্য ভৈরব একটি আশির্বাদ। সেই সাথে মেহেরপুরে পাতি হাস পালন একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। এর ডিমের পুষ্টগুন অনেক ও মাংসও বেশ সুস্বাদু।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স্বপন কুমার খা জানান, মেহেরপুরে ইতিমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে পাতিহাঁস পালন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে বাচ্চা ও ডিম কিনতে। হাঁস পালনে তেমন খরচ হয় না । এদের খুব একটা পরিচর্যাও করা লাগে না। নিজেদের ইচ্ছেমত বেড়ে উঠে। মেহেরপুর কৃষি বিভাগ থেকে এই ধরনের খামারিদের এগিয়ে নিতে তাদের যেকোন সহযোগীতা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। এছাড়াও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা খামারে খামারে গিয়ে খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আর্থিক ভাবেও সহযোগী করা হচ্ছে। যাতে খামারি সহজ শর্তে লোন তুলতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।