২৮ অক্টোবর ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই সত্য হলো। রাজপথের রাজনীতি সংঘর্ষে রূপ নিল। এবারের সহিংসতায় নতুনমাত্রা যুক্ত হলো- হাসপাতালে আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ; বিরোধী রাজনৈতিক দল কর্তৃক সাংবাদিক পেটানো ও প্রধান বিচারপতির বাসভবন আক্রমণের ঘটনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে দিয়ে কত মিছিল অতিক্রম করেছে, কিন্তু প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আক্রমণ, ভাঙচুর, বাসভবনের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে এমন ঘটনা অশ্রুত, নজিরবিহীন। তবে এমন ঘটনায় অবাক হইনি। কারণ কয়েক বছর ধরে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও তার মিত্ররা যেভাবে বিদ্বেষ, বিষোদগার ছড়িয়েছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা নজিরবিহীনতাতে বিচার বিভাগ রোষের শিকার হবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক আন্দোলনের অপকৌশল হিসেবে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে।
বিএনপির কোনো রাজনৈতিক নেতার অপরাধের বিরুদ্ধে রায় হলে তাকে ফরমায়েশি রায় বলা হচ্ছে। ক্ষমতা পরিবর্তন হলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচার করার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। বিচারকের বিরুদ্ধে আদালতে জুতা মিছিল করা হচ্ছে। রায়ের বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি তারেক রহমান ও জোবাইদা রহমানের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতা বিচার বিভাগকে পুলিশের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। একজন বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ এখন পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।’ আরেকজন বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ এখন পুলিশের এক্সটেনশন।’ বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা প্রকাশ্য সভায় বিচারককে হুমকি প্রদান করে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে সব বিষয়ের বিচার তো হবেই। সবার আগে বিচার হবে যে বিচারক এই রায় দিয়েছেন।
’আক্রমণে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে পোস্টারিং। সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে ৬৪টি জেলা আইনজীবী সমিতিতে ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আনফেয়ার জুডিশিয়ারি’ লেখাসংবলিত পোস্টার লাগিয়েছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসংবলিত সেই পোস্টার। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল পোস্টারের বিষয়ে বলেছেন, “আমাদের কথাই ওই পোস্টারে লেখা আছে। সারা দেশে বিচারের নামে প্রহসন চলছে। আদালতের পরিবেশ আজ দ্বিধাবিভক্ত। আজ বিএনপির জন্য এক আইন প্রচলিত, অন্যদের জন্য আরেক আইন। এ কারণে আমরা বলছি ‘উই ডিমান্ড ইমপারশিয়াল অ্যান্ড ফেয়ার জুডিশিয়ারি’ (আমরা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার বিভাগ চাই)।”
রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও ভয়ংকর আচরণ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও কয়েকজন আইনের শিক্ষক। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। খালেদা জিয়ার মামলায় হাইকোর্টে রায়দানকারী বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন দিনাজপুরের পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। শুধু বিরূপ মন্তব্য করেই তিনি থেমে থাকেননি, বিচারের রায় নিয়েও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। মেয়রের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে নিয়ে অশালীন ও বিচারাধীন বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে এক মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ৬ নভেম্বর তাঁকে হাজির হয়ে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। আরেকটি বক্তব্যে হাবিবুর রহমান হাবিব বিচারপতি আখতারুজ্জামানকে হত্যার হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘শপথ করে বলে যেতে চাই, এই সরকার যেদিন ক্ষমতায় থাকবে না, ওই বিচারপতি আখতারুজ্জামান জীবিত থাকলেও তাঁকে মরতে হবে, মরে গেলেও কবর থেকে লাশ ওঠানো হবে।’ খালেদা জিয়ার মামলার বিচার বন্ধে বিএনপির আইনজীবীরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন ১৩ বার। ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় বিএনপির আইনজীবীরা বিচারক পরিবর্তনের আবেদন করলে উচ্চ আদালত তিনবার বিচারক পরিবর্তন করে দেন। চতুর্থবার বিচারক পরিবর্তনের আবেদন করলে উচ্চ আদালত তাতে রাজি হননি। বিচারপতি আখতারুজ্জামান নিম্ন আদালতে তিনবার বিচারক পরিবর্তনের পর চতুর্থ বিচারক হিসেবে খালেদা জিয়ার মামলার বিচার করেন। দ্রুত বিচার আদালতের মামলা ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও ১০ বছরব্যাপী ২৬১ কর্মদিবসে ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার রায় প্রদান করা হয়। বিএনপির আইনজীবীরা ১৫৫ বার সময় প্রার্থনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষীদের জেরা করেছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ২৮ দিন ধরে শুধু আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছেন। তার পরও কেন বিচারকের প্রতি ক্ষোভ, হত্যার হুমকি?
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামানকে হত্যার হুমকি দিয়ে দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে সাজা দেওয়ায় বিচারকের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। একজন চিঠি প্রদানকারী বিচারককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আরেকজন হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
একজন রাজনৈতিক নেতার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে বিচার বিভাগের প্রতি আক্রমণ, বিদ্বেষ, শত্রুতা কিংবা বিমাতাসুলভ আচরণ বিচার বিভাগের প্রতি অন্যায়, আত্মঘাতী। তারেক ও জোবাইদা রহমানের বিচারের সমসাময়িক সময়ে ভারতে রাহুল গান্ধী, পাকিস্তানে ইমরান খান এবং যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিচার হয়েছে। অতীতে ইতালির চারবারের প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি বিচারে কয়েকবার জেল খেটেছেন। ব্রাজিলের লুলা ডি সিলভা দুই দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিচারের রায়ে ৫৮০ দিন জেল খেটেছেন। নির্বাচনে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাক গান হে দুর্নীতির কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন এবং তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ১০ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। দুর্নীতির একটি মামলার তদন্তে সহযোগিতা না করায় তাঁকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ৭০ বছর বয়সে জেলে যেতে হয়েছিল মিস্টার জুমাকে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কয়েকটি মামলার মধ্যে একটিতে ১২ বছরের জেল হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট প্রতারণার অভিযোগে দুই বছর তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা ক্ষমতায় থাকার সময় চালে ভর্তুকির একটি দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট জিনাইন আনেজ প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের দায়ে ১০ বছরের সাজা ভোগ করছেন। কোথাও কি রায়ের পর জুতা মিছিল হয়েছে? কোনো দেশে রায়কে কি ফরমায়েশি রায় বলে উল্লেখ করে বিচার বিভাগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে?
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সংর্বধনা বর্জন করে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মোর্চা ইউনাইডেট লইয়ার্স ফ্রন্ট। যে কেউ সংর্বধনা বর্জন করতেই পারে, কিন্তু সংর্বধনাস্থলের পাশে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ বিদ্বেষের বার্তা দেয় বৈকি। মাঠের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ জনগণকে বিচার বিভাগ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক ও বিচারপতিদের প্রতি বিরূপ ধারণা প্রদান শুধু অযৌক্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, এটি আত্মঘাতীও বটে।
আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিচারক কেবল আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করেন। মূল আইনি লড়াই হয় দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। এক পক্ষের যুক্তিতর্ক-সাক্ষ্য খণ্ডন করে অপর পক্ষ যুক্তিতর্ক-সাক্ষ্য উপস্থাপন না করতে পারলে তার দায় ওই আইনজীবীর। কোনো পক্ষ যদি মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপন করে, প্রতিপক্ষ তা খণ্ডন করতে না পারলে বিচারকের কী করার আছে? বিচারক যখন রায় লেখেন, উভয় পক্ষের উপস্থাপিত ঘটনার সারসংক্ষেপ, তাদের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক ও সাক্ষ্য-প্রমাণের কথাই রায়ে উল্লেখ করেন। কোনো কিছুই গোপনে করা হয় না। এখানে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কোথায়? নিম্ন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ আছে। হাইকোর্টের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এর পরও যদি বিএনপি মনে করে নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ সবই দলীয়করণ হয়ে গেছে, সবাই আওয়ামী লীগ, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সরকার চালাবে কিভাবে? বিএনপি সরকার গঠন করলে নির্বাহী বিভাগের রাজনৈতিক অংশ পরিবর্তন হবে। চাইলে আমলাদের কাউকে অপসারণ করতে পারবে। নির্বাচনে জয়ী হলে আইন বিভাগের তথা সংসদ সদস্যরাও পরিবর্তন হতে পারেন। কিন্তু বিচার বিভাগের কোনো সদস্যকে বিএনপি নিজেদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন বা অপসারণ করে নতুন বিচারক নিয়োগ করতে পারবে না। এই বিচারকদের নিয়েই বিচারকাজ পরিচালনা করতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে মহাজোট সরকার ও সরকারদলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘সরকার যদি মনে করে- তারা বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে, তাহলে আমি বলতে চাই যে সেই প্রতিযোগিতায় আপনারা পরাজিত হবেন। কারণ যারাই বিচার বিভাগের ওপর হাত দেয়, সেই হাত পুড়ে যায়। সরকার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগের অস্তিত্ব, ইজ্জত-সম্মান, মর্যাদা সব সময় থেকেছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’
শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এ কাজে মূল ভূমিকা পালন করছেন খােলদা জিয়ার সাবেক সহকারী প্রেসসচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী ও দেশি-বিদেশি কয়েকজন অধ্যাপক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, বিএনপি, জামায়াত ও তাদের মিত্ররা বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কী ভয়ংকর রোষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিচার বিভাগের প্রতি ধারাবাহিকভাবে যে বিদ্বেষ ও অনাস্থা উগরে দেওয়া হচ্ছে, তারই ফলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা। বিচার বিভাগের অভিভাবক হলেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আক্রমণ প্রকারান্তরে বিচার বিভাগের ওপর হামলা। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের ওপর হামলা রাষ্ট্রের ওপরও হামলা।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়