১৯৬২ থেকে ১৯৭০। স্বাধীনতার আগের উত্তাল ৮ বছর। পাকিস্তানের শাসকরা যে পূর্ব পাকিস্তানকে কেবলই শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে সেই কথা শুনিয়ে স্বাধিকারের দাবি নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
এই সময়েই ৬ দফার দাবি তুলে গণমানুষের নেতায় পরিণত হন তিনি। তার সমর্থক ছিলেন, খুলনার রশিদ ব্রাদার্স জুট মিলের মালিক আব্দুর রশিদ মিয়া।
বঙ্গবন্ধু খুলনায় এলেই জনসভার জন্য প্রাইভেট কার পাঠাতেন তিনি, আর সে গাড়ির চালক ছিলেন ছমির উদ্দিন। টানা আট বছর খুলনা-যশোর ও আশেপাশের জেলাগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে প্রাইভেট কারে জনসভায় নিয়ে যাওয়ায় ছিলো ছমির উদ্দিনের কাজ। তার ভাণ্ডারে আছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গল্প। জীবন সায়াহ্নে এসে সেসব গল্প বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে একবার শোনাতে চান তিনি। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয় ছমির উদ্দিনের।
তিনি জানান বর্তমানে তার বয়স ৮৮ বছর। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতি এখনও পরিষ্কার। স্পষ্ট মনে করতে পারেন ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সালের ঘটনাবলি।
‘বঙ্গবন্ধু তো তাকে পরে বলা হয়েছে, আমরা বলতাম শেখ সাহেব’-গল্প শুরু হয় তার। শেখ সাহেবকে প্রাইভেট কার চালিয়ে নিয়ে গেছি অনেক জায়গায়।
দলীয় প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়া থেকে লঞ্চে করে খুলনায় আসতেন। সে সময় তাকে প্রাইভেটে (প্রাইভেট কার) করে খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন স্থানের মিটিংয়ে নিয়ে যেতাম।’ছমির উদ্দীন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের নৃসিংহপুর গ্রামের মৃত মনির উদ্দীন বিশ্বাসের ছেলে।
তিনি জানিয়েছেন, ১৯৬২ সালে খুলনা রশিদ ব্রাদার্স নামের একটি জুট মিলে ড্রাইভার পদে চাকরি করতেন। রশিদ ব্রাদার্স জুট মিলের মালিক ছিলেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার আব্দুর রশিদ মিয়া। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ করতেন এবং সাবেক এমএলএ ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুকে সবাই শেখ সাহেব বলতেন।
‘শেখ সাহেব তখন লঞ্চে করে টুঙ্গিপাড়া থেকে খুলনায় আসতেন। শেখ সাহেব, আসার আগেরদিন রশিদ সাহেব আমাকে গাড়ি নিয়ে লঞ্চের ঘাটে থাকতে বলতেন। আমিও গাড়ি নিয়া চলে যেতাম ঘাটে। শেখ সাহেব, খুলনায় লঞ্চ থেকে নেমে আমার গাড়িতে উঠতেন। আমি গাড়ির দরজা খোলা রাখতাম।
গাড়িতে ওঠার আগে তিনি আমার গায়ে ও মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তানের মতো আদর করতেন। খুলনার যেসব স্থানে সভা সমাবেশ থাকতো সেখানে শেখ সাহেবকে নিয়ে যেতাম। তবে তিনি খুলনায় এলে দুপুরের খাবার খেতেন টুটপাড়ায় তার ছোটভাই শেখ আবু নাসেরের বাসায়। এখানে তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে খেতেন না। সাধারণ মানুষের মতো মেঝেতে পাটি পেড়ে খেতে বসতেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আমাকেও বসাতেন। বাড়িতে যাওয়ার আগে বলতেন, ছমির খুলনায় এসে যদি ছোটভাই এর বাড়িতে না যাই আর দুপুরে না খেয়ে আসি তাহলে ও খুব কষ্ট পাবে।’
‘খাওয়া-দাওয়া শেষে যেখানে মিটিং থাকতো সেখানে নিয়ে যেতাম। যে কয়দিন তিনি খুলনায় থাকতেন সে কয়দিন আমি ডিউটি করতাম।’
বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার কোনও বিশেষ স্মৃতি আছে কিনা জানতে চাইলে ছমির উদ্দীন জানান, ‘‘একদিন খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে শেখ সাহেব ভাষণ দিচ্ছিলেন । সে সময় আমি পাশেই গাড়ির দরজা খুলে বসেছিলাম। শেখ সাহেব কোনও রকম ভাষণ শেষ করে আমাকে বলেন ‘দ্রুত গাড়ি চালাও। আমি অ্যারেস্ট হয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে।’
পরে আমাকে জানালেন, ‘মোনায়েম খান, সবুর খানের কাছে টেলিফোন করেছে শেখ সাহেবকে অ্যারেস্ট করার জন্য। আমি তখন তরতাজা যুবক। আমি সে সময় গাড়ি নিয়ে দ্রুত যশোরের সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমানে বাড়িতে চলে আসি। রাতে থাকার পর সকালে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখি মশিউর রহমান সাহেবের বাড়ির সামনে পুলিশ। তখন আমি আর গাড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেলাম না। ব্যাকেই আবার বিল্ডিংয়ের গ্যারেজে ঢুকে গেলাম।
এরপর শেখ সাহেবকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। ওই দিনই কোর্টে উনার জামিন হওয়ার পর শেখ সাহেবকে নিয়ে গাড়িতেই ঢাকায় চলে গেলাম। এটাই ছিল আমার জীবনের একটা বড় স্মৃতি।’
গাড়ি চালানোর পাশাপাশি খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন ছমির উদ্দীন। এলাকায় তাকে ‘গুরু’ ডাকা হয়। তৈরি করেছেন অনেক বাঁশি শিল্পী। তিনি আরও জানান, ‘বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
বঙ্গবন্ধু কেমন মানুষ ছিলেন জানতে চাইলে বলেন, কেমন মানুষ ছিলেন সেটা বলে বোঝানো যাবে না। একজন সুন্দর মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। গরিব মানুষ বলে কাউকে সরিয়ে দিতেন না। বুকের মধ্যে, কোলের মধ্যে নিয়ে আদর করতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের এমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে সেটা কেউ ভাবতেই পারিনি। খুলনার কাজ শেষে ফেরার পথে প্রতিবার আমাকে পকেটে জোর করে ৫০ টাকা করে বকশিস দিয়ে যেতেন। এমন মানুষ বা এমন নেতা আর আমাদের দেশে আর আসবে না।’
বৃদ্ধ ছমির উদ্দীন আরও জানান,‘ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ সাহেব যখন জেলে গেলেন তখন আমি শেখ সাহেব এর স্ত্রী, বড় ছেলে, ছোট ছেলে, শেখ সাহেবের ব্যারিস্টার ও মশিউর রহমান সাহেবকে গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসতাম। তারা সবাই শেখ সাহেবকে দেখতে ঢাকায় আসতেন। তখন ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে স্পেশাল কোর্ট ছিল। সেখানে তারা শেখ সাহেবের সাথে দেখা করতেন। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর শেখ সাহেবের সাথে আমার আর কোনও যোগাযোগ হয়নি ‘
১৯৬৮ সালে ছমির উদ্দীন ঝিনাইদহে চলে আসেন। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তখন তিনি কালীগঞ্জ শহরে বসবাস শুরু করেন এবং মোবারকগঞ্জ সুগার মিলে চাকরি পান। চিনিকলে তিনি ট্রাক চালাতেন। বর্তমান ছমির উদ্দীন কালীগঞ্জ শহরের বিহারী মোড়ের নিজের একটি বাড়িতে বসবাস করছেন।
এছাড়া ছমির উদ্দীন খুলনা বেতার চালু হওয়ার পর থেকে সেখানকার একজন নিয়মিত বংশীবাদক ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট বংশীবাদক বলে পরিচিত। ঝিনাইদহ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রয়েছে তার অনেক সুখ্যাতি। তার হাতেই তৈরি হয়েছে জেলার বেশিরভাগ বাঁশি শিল্পী। খুলনা বেতার থেকে এখনও তার কাছে প্রোগ্রামের জন্য চিঠি আসে। সেখানে তার একটি সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়েছে।
এছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমি তাকে সম্প্রতি সংবর্ধনাও দিয়েছে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি এখনও নিয়মিত রেডিও শুনেন। জীবন সায়াহ্নে এসেও মাঝে মাঝে বাঁশি বাঁজানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এখন বয়সে আর কুলায় না। তার বাড়িতে বস্তায় ভরা রয়েছে অসংখ্য বাঁশের বাশি। ব্যক্তিগত জীবনে ছমির উদ্দীন ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ছমির উদ্দীন একবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো স্মৃতিকথাগুলো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে শোনাতে চান। ছমির উদ্দিন বলেন, ‘অনেক বার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে কিন্তু আজও পর্যন্ত দেখা পাইনি। একবার যদি দেখা পেতাম, তাকে বলতাম বঙ্গবন্ধুর সাথের স্মৃতিগুলো, এই শেষ বয়সে মনটা জুড়িয়ে যেত।’