‘তালগোল পাকানো’ শব্দটার প্রতিশব্দ হলো, মারাত্মক ভুল; মন্দভাবে পরিচালনা করা ইত্যাদি। এই ‘তালগোল পাকানো’ শব্দটা বর্তমান রাজনীতিতে সুনির্দিষ্ট করে বললে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য। কীভাবে?
আপনি যদি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বা রাজনীতি সচেতন মানুষ হন তবে গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখবেন, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে প্রধান স্পোক পার্সন আসলে কে এটা খুঁজে পাওয়া যাব না। একেক সময় একেকজন আর্বিভূত হন। যখন কাউকে পাওয়া যায় না তখন অবতাররূপী কাউকে কাউকে দেখা যায়।
কে তাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে বা কে তাদের রাজনৈতিক নির্দেশনা দিচ্ছে? এইরকম একজন নয়, অসংখ্য লোক পাবেন। কেন অসংখ্য? কারণ তারা আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে নিয়ে রাজনীতি করছে না। সময়ের সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়। একেক সময় তারা একেক ধরনের দফা-রফা নিয়ে মাঠে নামে। সহজ করে বললে, তাদের রাজনীতি হলো ‘প্রেসক্রিপশনের রাজনীতি’।
ডাক্তার যেমন রোগী দেখে বিভিন্ন ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিও বহুজনের প্রেসক্রিপশনে বা বহুজনের মতামতে বা বিদেশি নির্দেশ বা সুপারিশে চলছে।
বাংলায় দুইটি প্রবাদ বাক্য বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির জন্য প্রণিধানযোগ্য। ‘নানা মুনির নানা মত’ ও ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’। এই অধিক সন্ন্যাসীরা কখনো বলছেন সংলাপ প্রয়োজন, কখনো বলছেন সংলাপ প্রয়োজন নেই বা বিএনপি সংলাপে যাবে না।
এরা কখনো বাইডেনের প্রতিনিধি ধরে আনে, কখনো বৈদেশিক শক্তির ভয় দেখায়, কখনো নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেয়, কখনো সরকার পতনের ঘোষণা দেয়, কখনো আবার ১১ দফা বা ১ দফার ঘোষণা দেয়। এতসব ঘোষণা বা কর্মসূচির ভিড়ে তাদের আসল লক্ষ্য কী তাই বোঝা যাচ্ছে না।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিএনপি-জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডায় জনগণের চাহিদা গুরুত্ব পায়নি। জনগণ যখন পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে প্রতিবাদ করছে তখন তাদের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, নেই আন্দোলন, নেই বিক্ষোভ। তখনো তারা সরকার পতন নিয়ে ব্যস্ত। সরকার পতন অবশ্যই তাদের আন্দোলনে থাকবে কিন্তু তার সাথে সাথে জনগণের চাহিদা কেন তাদের মাথায় থাকবে না তা আমরা বুঝি না। এর মূল কারণ হলো, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের এই প্রেসক্রিপশন তাদের নিজেদের নয়। অন্য কোনো শক্তির বলে দেওয়া আন্দোলন বা এজেন্ডা। মূল কারণ হলো, ‘নানা মুনির নানা মত’ ও ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’।
একদিকে যেমন নেতৃত্ব শূন্যতা অপরদিকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাও বিভিন্নজনের ‘প্রেসক্রিপশন’ শুনে মূল বিষয় বলতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন।
যখন নিজেদের লক্ষ্য স্থির থাকে না তখন বাইরের কেউ এসে তার মতো করে লক্ষ্য স্থির করে দেয়। যেমন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘বিএনপির ভোটে অংশ নেওয়া উচিত। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আমি এই দল থেকেই নির্বাচন করব।’ অথচ এই কথাটা বিএনপির বাকি নেতাদের মুখে নেই। তারা একেকসময় একেক কথা বলছেন। বিএনপির সামগ্রিক অস্থিরতা এখন দলের বিভাজন রেখা বড় করে দিয়েছে।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, তৃণমূল বিএনপি দলীয় নিয়ম নীতি মেনে পরিচালিত হবে। প্রাইভেট কোম্পানি হবে না। তৃণমূল বিএনপি হবে বাংলাদেশের তৃণমূল কংগ্রেস। আমরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার আশ্বাস পেলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেন।
অনেকেই ধারণা করছেন, একাধিক রাজনৈতিক মতবাদের কারণে তাদের এই বিভাজন। আরও বিস্ময়কর হলো, ২৮ তারিখ থেকে হরতাল, অবরোধের কর্মসূচির ঘোষণা এসেছে বিএনপি থেকে। তাদের সিনিয়র নেতার এই কর্মসূচি দিয়েছেন। এখন দিচ্ছে গণতন্ত্রর মঞ্চ আর জামায়াত।
সরকারের পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে আগামী ১২ ও ১৩ নভেম্বর সারা দেশে চতুর্থ দফায় (৪৮ ঘণ্টা) সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
রোববার (১২ নভেম্বর) ও সোমবার (১৩ নভেম্বর) আবারো টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠন, আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানসহ সকল রাজবন্দি এবং ওলামা-মাশায়েখের মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
এরা কিন্তু একসাথে রাজনীতি করে, অথচ তারা একেক উদ্দেশ্য নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে অবরোধ ডাকছে। বিষয়টা কি এখন পরিষ্কার যে, যে দলের কাছে যে ধরনের প্রেসক্রিপশন আসছে তারা সেইভাবে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মসূচি দিচ্ছে।
তাদের জোটবদ্ধ হয়ে লক্ষ্যে ফিরতে হবে। ক্লোজআপ ওয়ানের সেই গানের মতো—যদি লক্ষ্য থাকে অটুট বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে। বিএনপি-জামায়াতের উচিত বিভিন্নজনের প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে রাজনীতি করা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।