৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাবার পর থেকে হদিস নেই সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের। অনেকেই ধারনা করেন তিনি সীমান্ত ফাঁকি দিয়ে ভারত পালিয়েছেন। তবে প্রথম দিকে গুঞ্জন উঠেছিলো কানাডায় পালিয়েছেন। তবে তিনি কোথায় কেউ জানেন না। সরকার পতনের দিনই বিক্ষুব্ধ জনতা তার মেহেরপুরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফরহাদ হোসেন ও তার পরিবার জেলার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। নিজ দলের দুর্দিনের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে তিনি জেলার আওয়ামী রাজনীতি, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের টেন্ডার, পন্য সরবরাহ ব্যবস্থা, সরকারি অফিসসমূহের নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার একক কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। জেলার শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি অঙ্গনেও থাবা বসান।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্রীড়া সংস্থা, ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ, প্রেসক্লাব সর্বত্র তিনি নিজের অযোগ্য লোকদের বসিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে যান। তার এসব অপকর্মের সহায়ক ছিলেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার বিরোধী বলয়ের কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার ছিলনা। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতেও বারণ করা হতো। তিন খলিফার সাথে পরামর্শক্রমে প্রশাসন চালাতেন সাবেক ডিসি আতাউল গণি, ড. মনসুর আলম খান ও বর্তমান ডিসি শামীম হাসান। পিপি পল্লব ভট্টাচার্য, প্রফেসর হাসানুজ্জামান মালেক ও জেলা আওয়ামীলীগ যুগ্ম সম্পাদক ইব্রাহিম শাহীনদের নিয়ে ডিসির ছাদের গোলঘরে নিয়মিত অফিস শেষে সভা বসত। গত নির্বাচনের আগ মুহুর্তে অবশ্য হাসানুজ্জামান মালেকের সাথে মন্ত্রীর দুরত্ব বাড়ে, তাই এক খলিফা বাদ নতুন খলিফা শ্বাশ্বত নিপ্পনের আবির্ভাব হয়। এখান থেকে নানা পরিকল্পনা হত। ব্যতিক্রম ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। তিনি পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করে ডিসি অফিসকে দল, মত নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। ঝিমিয়ে পড়া শিল্পকলা, ক্রীড়া সংস্থা ও পাবলিক লাইব্রেরি পুনর্গঠন ও উপযুক্ত লোক দিয়ে গতিশীল করার পরিকল্পনা করেন।যুগ যুগ ধরে শহরের ভেতর গড়ে ওঠা অবৈধ ট্রাক-বাস স্ট্যান্ড পৌর টার্মিনালে স্থানান্তরসহ নানাবিধ জনবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। https://youtu.be/_xScWUFlbRc?si=mwQgzbq2fRUe_ZCj
মন্ত্রীর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে প্রশাসনকে তিনি জনবান্ধব ও গণমুখী প্রশাসনে পরিনত করার নানা উদ্যোগ নেন। কিন্তু এসমস্ত জনবান্ধব উদ্যোগ মন্ত্রী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের রুষ্ট করে। যার ফলে মাত্র ৩ মাসের মাথায় নির্বাচনের আগেই তাকে প্রত্যাহার করে নেন। তার আগেও আরেকজন জেলা প্রশাসক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনিও মন্ত্রীর আস্থাভাজন না হওয়াতে মাত্র চার মাসে মেহেরপুর থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তার আগে শফিকুল ইসলাম নামের আরেক জেলা প্রশাসককেও বছর খানেকের মধ্যে বদলি করেন ফরহাদ হোসেন।
জেলার যেকোন কর্মকর্তা নির্বিবাধে মন্ত্রী ও তার পরিবারের আদেশ নির্দেশ পালন করতেন। কেউ অন্যথা করলে তার শাস্তি ছিল অবধারিত। ফরহাদ হোসেনের রাজনীতি ছিল মুলত প্রশাসন ও পুলিশ নির্ভর।
২০১৪ সালের পূর্বে এলাকার সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিলনা। ছিলনা রাজনৈতিক কোন পদ পদবী। এলাকায় কোন পরিচিতিও ছিলনা। হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনাভোটের নির্বাচনে হয়ে যান এমপি। ২০১৮ সালে কথিত রাতের ভোটের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হন। ছাত্রজীবনে তার বিভাগের সিনিয়র তৎকালীন ডিসি ড. আতাউল গণির উপর ভর করে রাতের ভোট নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেন। প্রশাসনকে চরম দলীয়করণ তার সময়েই শুরু হয়। সর্বশেষ বিরোধীদলবিহিন একপেশে নির্বাচনেও তার পছন্দের ডিসি শামীম হাসান ও এসপি রাফিউল আলমের উপর ভর করে নির্বাচনী মাঠ সাজান। তবে, প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীর অভিযোগে নির্বাচনের আগে এসপি প্রত্যাহার হলেও থেকে যান ডিসি। তার উপর ভর করে কারচুপির নির্বাচন করে বিজয়ী হন। তবে তার পছন্দেও ডিসি শামীম হাসান এখনও মেহেরপুরের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, পুলিশ সুপার এস এম নাজমুলকে ইতোমধ্যে বদলি করা হয়েছে। তবে নতুন এসপি পদায়ন হয়নি।
জেলার জনপ্রতিনিধিদের সাথে ফরহাদ হোসেনের বিরোধ ছিল। আওয়ামী লীগের বিরোধ নিয়ে কোন সাংবাদিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করলে তাকে বিরোধী দলের ট্যাগ দিয়ে তার সাঙ্গ পাঙ্গদের দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতো। তার বিরোধের জের বিশেষত গাংনী আসনের এমপি শহীদুজ্জামান খোকন, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইয়ারুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম, সদর পৌরসভার মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন ও কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যক্রমে তার অযাচিত হস্তক্ষেপের কারনে দ্বন্ধ বিরোধের সৃষ্টি হয় ও জেলার সার্বিক উন্নয়ন ব্যহত হয়। প্রশাসন ও পুলিশ নিরপেক্ষ হওয়ার প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন এবং তার পরিবার ও আত্মীয়কেন্দ্রিক রাজনীতি কোথাও দেখা যাচ্ছেনা।
সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, অনলাইন জুয়ার পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেহেরপুর প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশ করবে। মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। চোখ রাখুন মেহেরপুর প্রতিদিনে।