করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও সুরক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু পরামর্শ ও তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে। একে অপরকে ইনবক্স করছেন। নিজেদের টাইমলাইনে পোস্ট করছেন, শেয়ার করছেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পরামর্শ ও তথ্যের অধিকাংশই ভুয়া ও গুজব। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের আতঙ্কেই ফেসবুক, টুইটারে এসব ভুল তথ্য প্রদান করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসব পরামর্শ মানলে কোনো উপকার তো হবেই না উল্টো ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন মানুষ।
সে জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে করোনাভাইরাস উপশমে এ রকমই কিছু ভুয়া পরামর্শ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সেই প্রতিবেদন অবলম্বনে প্রচলিত ভুল তথ্য এবং সেগুলোর সঠিক বিষয় সম্পর্কে এখানে জানানো হলো।
রসুন
করোনাভাইরাসের আবির্ভাব হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে দেখা গেছে রসুন খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রসুন সবসময়ই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে বিদ্যমান ‘অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল’ উপাদান শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু রসুন করোনাভাইরাস থেকে বাঁচায় এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। রসুন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকের কাজ করে না।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য সাউথ চায়না মর্নিং’ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের জীবাণু থেকে বাঁচতে চীনে একজন নারী ১.৫ কেজি কাঁচা-রসুন খেয়েছিলেন। তাতে তার গলা ফুলে যায় এবং জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে।
তাজা ফলমূল, সবজি ও পর্যাপ্ত পানি পান
অনেকেই বলছেন, তাজা ফলমূল, সবজি ও পর্যাপ্ত পানি পান শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, করোনা থেকে বাঁচতে এসব উপাদান কার্যকর।
খনিজ
জর্ডান সাথের নামক একজন ইউটিউবার কয়েকটি ভিডিওতে দেখিয়ে বলেন, ‘মিরাকেল মিনারেল সাপ্লিমেন্ট’ (এমএমএস) করোনাভাইরাস দূরে রাখতে সহায়তা করে।’
কারণ এতে আছে ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড নামক ব্লিচিং উপাদান। এই উপাদান যেমন ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করে এবং করোনাভাইরাসও দূর করে।
কিন্তু গত বছর ‘ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) চালানো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এমএমএস প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে বলে কোনো নজির পাওয়া যায়নি। উল্টো এটি পান করলে বমি হয়, ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে আরও কিছু ক্ষতিকর দিক।’
ঘরে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার
অনেক ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার জেল তৈরির উপায় জানা যায়। কারণ করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হলো হাত ধোয়া।
কিন্তু এই পদ্ধতি অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে মানানসই নয় এবং সব ধরনের ত্বকের জন্যও উপযোগী নয়।
এর ব্যাখ্যায় ‘লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকেল মেডিসিন’য়ের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড বলেন, ‘৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড জেলে সাধারণত ‘ইমোলিয়েন্ট’ থাকে, যা ত্বককে কোমল রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু ঘরে বসে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল সমৃদ্ধ স্যানিটাইজার বানানো সম্ভব নয়।’
প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি পান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুবার প্রচারিত হয়েছে, একজন জাপানের চিকিৎসক নাকি বলেছেন, ‘যিনি প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি পান করবেন তার মুখে করোনাভাইরাস প্রবেশ করলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই পোস্টের আরবীয় ভাষার অনুবাদটি ২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি প্রচার করেছে।’
ওই পরামর্শ বিষয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ট্রডিও লং জানান, ‘শরীরে এমন কোনো কার্যক্রিয়া নেই, যেখানে ভাইরাস পাকস্থলীতে যাবে এবং তা ধ্বংস হবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমণ শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে। এটি মুখের মাধ্যমেও প্রবেশ করতে পারে। তবে ক্রমাগত পানি পান যে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাবে তা ঠিক নয়।’
তবে পানি পান করা ও নিজেকে আর্দ্র রাখা স্বাস্থ্যগতভাবেই উপকারী।
আইসক্রিম এড়িয়ে চলা এবং তাপ
বিভিন্ন দেশেই ইউনিসেফের নামে মিথ্যা রটানো হয়েছে যে, ‘গরম পানি পান এবং সূর্যের আলো করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করে। আর এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব আইসক্রিম বাদ দিতে হবে।’
এটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। ইউনিসেফের পক্ষে কাজ করা কর্মকর্তা শার্লোট গর্নিটজকা বলেন, ‘সম্প্রতি ইউনিসেফের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে– আইসক্রিম ও অন্যান্য ঠাণ্ডা খাবার বাদ দিলে এই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে। এমন কোনো তথ্য ইউনিসেফ দেয়নি।’
গরমতত্ত্ব
গরমে সর্দির ভাইরাস টিকে থাকতে পারে না। তবে গরমে করোনাভাইরাসও মরে যাবে- এমন বিশ্বাস জনমনে। কিন্তু গরমে করোনা ধ্বংস হবে সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নন ভাইরোলজিস্টরা।
রোদে দাঁড়িয়ে থাকা
করোনাভাইরাসকে অকেজো করতে শরীরে তাপ জোগাতে হবে বা রোদে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন কথাও বেশ প্রচলন পেয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক ব্লুমফিল্ডের মতে, ‘এটা অকার্যকর ও ভুল ধারণা। এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর মারার কোনো উপায় নেই। দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাই একে মারতে পারবে। এ জন্য রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেহের বাইরে থেকে তাপ দিয়ে করোনাভাইরাস ধ্বংস করতে চাইলে প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন, যা কিনা গরম পানি দিয়ে গোসল করার চাইতে বহুগুণ গরম। অমন গরমে তো শরীর জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে।’
সুত্র-যুগান্তর