পর্যটন এবং পর্যটক আমার খুব পছন্দের শব্দ। এই শব্দ দুইটা শুনলেই মনে পড়ে যায় নৈস্বর্গিক সুখের স্মৃতি গুলো। সেই শৈশব থেকে আমার ভ্রমণের প্রতি একটা অন্যরকম দুর্বলতা ও ভালোলাগা কাজ করতো। এখনো মনে পড়ে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন পরিবারের সাথে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলাম। যার রেশ আমার ভিতর এখনো বিরাজমান।
আর এই ভালোবাসা ভালোলাগা থেকেই আমি বাংলাদেশে থাকাকালীন ট্যুরিজমের সাথে সম্পৃক্ত হই যার কারণে বাংলাদেশের প্রায় সব গুলো দর্শনীয় স্থান এবং স্থাপনা আমি অবলোকন করেছি স্বচোখে। আর তখন এতোটা আগ্রহী ছিলাম যে যার কারণে ট্যুর অপারেশন অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ঞঙঅই) এর সদস্য হয়েও ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করেছি।
ভ্রমণ মানুষের মনকে করে প্রসারিত ও উদার। ভ্রমণে আমি উপভোগ করেছি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্যপূর্ণ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত নান্দনিক স্থাপনা গুলো। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যার ১২০ কিলোমিটারের ভিতর কোন কাদা নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
শৈবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরণা, ইনানী সমুদ্র সৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকনাফ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে আত্মভোলা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
আবার ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্তিক স্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি।
বাস্তবিক অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি যা পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে থাকার কথা এবং উপলব্ধি করেছি পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশর সম্ভাবনা কতটুকু। এবং সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছি দেশ থেকে যখন নিউইয়র্ক আসি। প্রায় ১২ বছর হয়ে গেছে তখন আমার এখানেও চাকুরী আর ব্যক্তিগত ভ্রমণ মিলে প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ ঘুরেছি এবং একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি আমাদের দেশের চেয়ে এখানে এত সংখ্যক পর্যটক কেনো আসে।
আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌন্দর্য বহন করা একটা স্থপনার চেয়ে বহুগুণ সাদামাটা দর্শনীয় জায়গা ঘুরার জন্য আমাদের দেশের তুলনায় বেশি সংখ্যক লোক ভীড় করে প্রতিদিন। কিছুদিন আগে একটা জরিপ দেখলাম প্রতি বছর এক’শ কোটিরও ——–বেশি পর্যটক সারা বিশ্বে ভ্রমণ করে। তাহলে কেন আর বেশি সংখ্যক পর্যটক বাংলাদেশে আসছে না? বাধা কোথায় ?
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, অনেক প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন, বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চল, উপত্যাকা, ঝর্ণা, নদী, পাহাড়ি ঝিরি নদীমাতৃক বাংলাদেশ। ষড় ঋতুর বৈচিত্র্য ও নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশ পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময়। কিন্তু এ সম্ভবনা কাজে লাগলো যাচ্ছে না কেন? ১৯৯৯ সালে বিশ্বে পর্যটন খাতকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
এরপর দীর্ঘ ২০ বছর অতিবাহিত হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো আমরা এ পর্যটন খাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারিনি। নাহলে এ নিতান্ত ছোট দেশ মালদ্বীপের চেয়ে পর্যটনের আয়ে কেমন করে এত পেছনে পড়ে থাকে? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে কয়েক মাইলের ছোট একটি দ্বীপ /মালদ্বীপ পর্যটন খাতে প্রতি বছর বাংলাদেশি টাকায় আয় করছে ২ হাজার কোটি টাকা আর বাংলাদেশে এ খাতে যে আয় হয়ে থাকে, তা নগণ্য।
বহুদিন ধরে আমার অভিজ্ঞতা এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে এলো দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। অন্যদেশ গুলোর তুলনায় এবং তার ওপর এখন বিভিন্ন দেশে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণে সতর্কতা দিয়ে রেখেছে। অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রচার নেই । এখন আমার মনে হয় ‘যত্ন করলে রত্ন বাড়ে’ এই প্রবাদটা এখন আমাদের বোঝা উচিৎ খুব গুরুত্ব দিয়ে। কেননা কোনো শিল্পকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারক হিসেবে নিতে হলে তার বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার দরকার।
পরিকল্পিত ও বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মদ্যোগ গ্রহণ করা। এখন আমাদের করনীয় পর্যটকদের যাতায়াত, নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ সবকিছুর প্রতি নজর দেয়া। শহর, নগরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,দেশের সুস্থ আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা করা। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে পর্যটকরা কিছুটা নিরুৎসাহিত হোন এগুলো দূর করা।
এছাড়া পর্যটন শিল্পের প্রচার এবং প্রসারের জন্য মিডিয়া কর্মী যাঁরা আছেন তাঁদের আরো পজিটিভ হওয়া উচিত। সরকারি-বেসরকারি উভয়ের উদ্যোগের আন্তরিকতা বাড়ানো। বিভিন্ন পর্যটন স্পটে পর্যটকরা ছিনতাইসহ নানা রকমের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, এগুলোর প্রতি নজর দেয়া এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের সহযোগিতা করা নিশ্চিত করতে হবে।
এসব ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে দেখভাল করা হচ্ছেনা বলে বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি এবং এতোটা পিছিয়ে আছি যা রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে একটা পর্যটন বা দর্শনীয় স্থান তৈরী হওয়ার সাথে সাথে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়ে যায়। আর সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
এসব ব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হবে বিশ্বের হাজার হাজার ভ্রমাণ পিপাসু মানুষ। ফলে দেশ এখাত থেকে অর্জন করতে পারবে বৈদিশিক অর্থ যা কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করবে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সূচককে।