ভোকাল কর্ডের মাধ্যমে শব্দ উৎপন্ন হয় একথা সবার জানা। ভোকাল কর্ড থাকে ল্যারিংস তথা স্বরযন্ত্রে এটাও নতুন তথ্য নয়। এটি শ্বসনতন্ত্রের এমন একটি অংশ যা গলা থেকে ফুসফুসে বাতাস যেতে দেয়। বাতাস যখন ফুসফুস থেকে স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে নির্গত হয়, তখন এটি ভোকাল কর্ডগুলোকে কম্পিত করে। আর এতেই শব্দ তৈরি হয়।
ভোকাল কর্ড তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত: ভোকালিস পেশি, ভোকাল লিগামেন্ট ও এগুলোকে আবৃত করে রাখা একটি শ্লেষ্মা ঝিল্লি (মিউকাস মেমব্রেন্স)। এটি পৃষ্ঠকে আর্দ্র রাখে ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। তবে আমাদের আলোচনা মূলত ভোকাল কর্ডের স্বাস্থ্য নিয়ে নয়। একবার ভেবে দেখুন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার কণ্ঠেরও পরিবর্তন ঘটে। বিষয়টি তো খুব স্বাভাবিক তাই না? কিন্তু এর কারণটি জানার কি ইচ্ছে হয়নি? চলুন জেনে নেই:
বয়ঃসন্ধিকালের আগে নারী ও পুরুষের কণ্ঠস্বরে পার্থক্য খুব বেশি দেখা যায় না। তাই শিশুদের কণ্ঠ শুনে নারী ও পুরুষ আলাদা করা অনেক সময় কঠিন। সেটা কলকাকলি ও কলতান হিসেবেই আমরা কানে শুনে মনে ধারণ করি। মূল পরিবর্তন চোখে পড়ে বয়ঃসন্ধির সময় (মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮–১৩ বছর, ছেলেদের ৯–১৪) যখন হরমোন তাদের প্রভাব প্রয়োগ করতে শুরু করে। এতে স্বরযন্ত্রের গঠনে পরিবর্তন আসে। এ সময় পুরুষের অ্যাডামস অ্যাপল আরও বেশি প্রত্যক্ষ হয় এবং ভোকাল কর্ডের দৈর্ঘ্য বাড়ে। বয়ঃসন্ধির পরে পুরুষের ভোকাল কর্ডের দৈর্ঘ্য হয় সাধারণত ১৬ মিলিমিটার আর নারীর হয় ১০ মিলিমিটার। বয়ঃসন্ধির পর নারীর ভোকাল কর্ড ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সরু হয়। এই ছোট ও সরু ভোকাল কর্ডই পুরুষের তুলনায় নারীর স্বর সাধারণভাবে উচ্চ হওয়ার কারণ।
বয়ঃসন্ধির পরও হরমোন কণ্ঠস্বরকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ এখানেই সবকিছু শেষ নয়। একজন নারীর কণ্ঠস্বর তার ঋতুচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। অভিউলেটরি তথা ডিম্বাস্ফীতির পর্যায়ে কণ্ঠস্বর সবচেয়ে সুন্দর শোনায়। কারণ এই পর্বে গ্রন্থিগুলো সর্বাধিক শ্লেষ্মা (মিউকাস) তৈরি করে, যা ভোকাল কর্ডগুলোকে তাদের সর্বোত্তম কার্যকরী ক্ষমতা প্রদান করে। একটি নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভনিরোধক পিল গ্রহণকারী নারীদের কণ্ঠে কম বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। কারণ পিলটি ডিম্বস্ফোটন বন্ধ করে দেয়।
পিরিয়ডের আগে হরমোনের পরিবর্তন কণ্ঠনালীকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের শক্ত করে তোলে। অপেরা শিল্পীদের দিয়েই এর উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে পিরিয়ডের আগে নারীদের ‘গ্রেস ডে’ দেওয়া হতো, যাতে তাদের ভোকাল কর্ড অক্ষত থাকে। এবং যেহেতু নারীদের ভোকাল কর্ড সরু, তাই অতিরিক্ত ব্যবহারে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও বেশি হতে পারে।
শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশের মতো, ভোকাল কর্ডেরও বয়স বাড়ে। এটি একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়সের প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বরযন্ত্রটি তরুণাস্থির (কাটিলিজ) চেয়ে শক্ত, অনেকটা হাড়ের মতো হয়ে যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ৩০ বছরের পর ঘটতে শুরু করে। এটি ভোকাল কর্ডগুলোকে কম নমনীয় করে তোলে। এও মনে রাখতে হবে যে পেশিসমূহ ভোকাল কর্ড নড়াচড়া করতে দেয়, সেগুলোও আমাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হতে শুরু করে। ভোকাল কর্ডগুলোকে সচল রাখা লিগামেন্ট এবং টিস্যুগুলোও কম নমনীয় হয়ে ওঠে। কণ্ঠও ভারী হয়ে যায়। এছাড়াও ফুসফুসের পেশির কার্যকারিতা হ্রাস পায় — শব্দ তৈরি করতে ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাসের শক্তি কমায়। স্বরযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি প্রতিরক্ষামূলক শ্লেষ্মা উৎপাদনকারী গ্রন্থিগুলোর সংখ্যাও কমে যায়। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোকাল কর্ডের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে জীবনধারণের ধরনের কারণেও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
এতে ব্যক্তির কণ্ঠস্বরও পরিবর্তন হতে পারে। যেমনটা গায়কদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাদের জীবনের একটি ধরন আছে। এই ধরন অনুসারে তারা রেওয়াজ করে এবং নিজের কণ্ঠের যত্ন নেয়। আবার অনেক সময় ব্যক্তির নিজের গাফিলতিতে কণ্ঠের বারোটা বেজে যায়। এমন উদাহরণ গায়কদের জীবন থেকেই নেয়া যাবে। যেমন ধূমপান শ্লেষ্মা উৎপাদন বৃদ্ধি করে। তবে এর আরেকটা ঝুঁকি হলো ধূমপান মিউকোসাল পৃষ্ঠগুলোকে শুকিয়েও দিতে পারে। মদ্যপানের ফলেও অনুরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কারণগুলো ভোকাল কর্ডের ক্ষতি করতে পারে এবং কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আনতে পারে।
ধরুন আপনি ধূমপানের মতো বাজে অভ্যাসে নেই। কিন্তু আপনার রোগ হয়েছে। তখন চিকিৎসকের প্রেসক্রাইব করা কিছু ওষুধও কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করাতে পারে। যেমন ল্যারিঞ্জাইটিসের জন্য ব্যবহৃত করা স্টেরয়েড ইনহেলার। ‘ব্লাড থিনার’ ও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি করতে পারে। এতে কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। আবার ‘মাসল রিলেক্সেন্ট’ পেটের অ্যাসিডকে স্বরযন্ত্রে ফিরিয়ে দেয়। এতেও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ব্যবহার করা ছেড়ে দিলে সাধারণত ওষুধ থেকে হওয়া ক্ষতিগুলো চলে যায়। অর্থাৎ এই সমস্যা সাময়িক। বলা যাইয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
ভোকাল কর্ডের ক্ষতির আরও একটি কারণ হতে পারে অতিরিক্ত ব্যবহার। সাধারণত গায়ক কিংবা এমন অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি ক্ষতি দেখা যায় — যারা কাজের সময় তাদের কণ্ঠস্বর অনেক বেশি ব্যবহার করেন। এ তালিকায় আরও আছেন শিক্ষক কিংবা ফিটনেস প্রশিক্ষক। তবে নিয়মিত গলার ব্যায়াম, গলাকে বিশ্রাম দেয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করাসহ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। স্পিচ থেরাপিও অনেক সময় কাজে আসে। আপনার ভোকাল কর্ডের যত্ন আপনাকেই নিতে হবে। বয়সের বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু বয়স বাড়লেও অনেক সময় কণ্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা ধরে রাখা যায় তার প্রমাণও গায়করাই দেন। একটি সুষ্ঠ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। শুধু ফিটনেস নয়, সার্বিক সুস্থতার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও ফেলনা নয়।
সূত্র: ইত্তেফাক