ডোনার ও অঙ্গ ম্যাচিং না হলে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা কোনো ভাবে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যদি অঙ্গ দাতা (ডোনার) পাওয়া যায় এবং অঙ্গটি সুস্থ থাকে ও রোগীর সঙ্গে ম্যাচ করে এবং রোগীর যদি অন্য কোন জটিলতা না থাকে তাহলে করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ও হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। তিনি বলেন, যদি জোর করে করার ব্যবস্থাও নেন প্রধান প্রশ্ন হলো- ডোনার কোথায় পাবেন? অঙ্গ দিতে হলে তো ম্যাচিং করতে হবে। আর সেটি বাংলাদেশে থেকেই করা সম্ভব। বিদেশে কিভাবে একজনের পর একজন ডোনার ম্যাচ করাবে? সেটা কি সম্ভব প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট এই চিকিৎসক।
যদিও ৯ অক্টোবর সোমবার রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট জরুরি। তিনি বলেন, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে তার। আমরা যে চিকিৎসা দিচ্ছি তা তাৎক্ষণিক। জরুরি ভিত্তিতে তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
তবে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, হার্টে সমস্যা, কিডনি সমস্যা কিংবা স্ট্রোকের রোগীর লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে গেলে মৃত্যু হতে পারে। সাধারণত এই ধরনের রোগীর লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় না।
দেশে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বারডেম হাসপাতালে ১৯৯৯ সালে প্রথম হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিন যকৃৎ অস্ত্রোপচার কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার পর ২০১০ সালের জুন মাসে বারডেম হাসপাতালে বাংলাদেশে প্রথম সফল যকৃৎ প্রতিস্থাপন সম্পূর্ণ করা হয়। দ্বিতীয় সফল অস্ত্রোপচার ঘটে ২০১১ সালের আগস্টে। বারডেমের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তা করা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়মিত হয় না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
কেনো সত্তর উর্ধ কারোর ক্ষেত্রে এটা বিপদজনক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট অনেক বড় একটি সার্জারি। এটি যখন করা হবে , একজন অসুস্থ ব্যক্তির ন্যূনতম হলেও তো লিভার কাজ করছে, লিভারটি কেটে ফেলা হয় এবং নতুন লিভার সংযোজন করা হয়। এই সময় তো পুরো শরীর লিভার ফ্রি থাকে। সার্জারি করতে ৭-৮ ঘণ্টা লাগে। এসময় অন্যান্য অঙ্গ যদি একদম ভায়াবাল থাকে, যেমন কার যদি কিডনিতে সমস্যা না থাকে, হার্টে সমস্যা না থাকে যদি কারো স্ট্রোক থাকে, ডায়াবেটিস থাকে এই ধরনের ক্ষেত্রে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় না। এগুলো হচ্ছে হাই রিস্ক, অপারেশন টেবিলে মৃত্যুবরণ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আরেকটি বিষয় দেখতে হবে সেটি হচ্ছে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি দেখতে হবে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে আমরা ধরে নেই, একজন মানুষ হয়তো ১০ বছর বাঁচতে পারবে কিন্তু ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছাড়া আর কয়দিন বাঁচবে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট একজন চিকিৎসক তখনই করবে যখন দেখবে তিনি সফল হবেন, ১০ বছর অন্তত রোগী বাঁচবে বলে আশা করা যায়। যদি এমন হয় ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে গিয়ে রিস্ক বেশি হয়ে গেল তখন সেটি করা যাবে না।
ডোনার কীভাবে পাওয়া যাবে
মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ এর কয়েকটি ধারা ২০১৮ সালে সংশোধন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে- দুই ধরনের ব্যক্তির কাছ থেকে অঙ্গ সংযোজনের জন্য নেওয়া যাবে। ক্যাডাভেরিক অর্থাৎ হৃদপিন্ড স্পন্দনরত মানবদেহ যা অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ কর্তৃক ব্রেইন ডেথ বলে ঘোষিত এবং যার অঙ্গসমূহ অন্য মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য লাইফ সাপোর্ট দ্বারা কার্যক্ষম রাখা হয়েছে – এমন ব্যক্তির অঙ্গ সংযোজন করা যাবে।
এছাড়া নিকট আত্মীয় থেকে নেওয়া যাবে। এর মধ্যে আছে – পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি, আপন চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো ভাই অথবা বোন। আইন অনুযায়ী , অঙ্গ দাতা হিসেবে জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে বয়স ১৮ বছরের কম অথবা ৬৫বছরের ঊর্ধ্বে হলে অঙ্গ নেওয়া যাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে হেপাটাইটিস নির্মূল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় হেপাটোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে তো লিভার লাগবে, সেটা কিভাবে পাওয়া যাবে? যেকোনো সভ্য দেশের আইন হচ্ছে রোগীকে তার নিকট আত্মীয়র কাছ থেকে অঙ্গ নিতে হবে। প্রতিবেশি বা পরিচিত কেউ অঙ্গ দিতে পারবে না। যদি এমন হয় প্রতিবেশি দিতে ইচ্ছুক সেটি খুব কম দেশেই করা হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যাবে না, এটা শুধু ইজরায়েলে সম্ভব। এখন কথা হচ্ছে অঙ্গ পাওয়া যাবে কোথা থেকে?
তার মতে, অঙ্গ দিতে হলে তো ম্যাচিং করতে হবে। সেটি বাংলাদেশে করা সম্ভব। বিদেশে কিভাবে একজনের পর একজন ডোনার ম্যাচ করাবে? সেটা কি সম্ভব! যেকোনো ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য দেশে বসে ম্যাচিং করে নিতে হয়। ব্লাড গ্রুপ, ডোনারের অঙ্গ সুস্থ আছে কিনা, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস আছে কিনা, লিভারের এনাটমি কেমন, এগুলো সব জেনে নিতে হবে। তারপর ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে যাবে। এখন উদাহরনসরূপ ধরা যাক এগুলো টেস্ট যুক্তরাষ্ট্রে করানো হলো , এখন যদি না মিলে তাহলে আরেক ডোনার কি বললেই ভিসা পাবে?
তিনি বলেন, ৭৭ বছর বয়সে সাধারনত ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় না। কিন্তু এতে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু করতে গেলেও ডোনার লাগবে, সুস্থ অঙ্গ লাগবে যেটা রোগীর নিকট আত্মীয়র এবং এসব ছাড়া কোথাও ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব না।