শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা জেলার নাম কুষ্টিয়া।
এ জেলায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহর তীর্থভূমি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই কুষ্টিয়া, বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, এ উপমহাদেশের গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিণাথ, স্বদেশী আন্দোলনের নেতা বাঘা যতিন, নীলকর আন্দোলনের পথিকৃৎ জমিদার প্যারী সুন্দরী, অবিভক্ত ভারতের প্রধান বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রাধা বিনোদ পালসহ অসংখ্য গুণীজনের পীঠস্থান হিসেবে কুষ্টিয়াকে করেছে বিখ্যাত ও আকর্ষণীয়। পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এ জেলায় পর্যটকদের আগমন লেগেই থাকেই।
প্রাচীন ঐতিহ্য পদ্মা গড়াই বিধৌত কুষ্টিয়ার বিস্তীর্ণ জনপদজুড়ে এখন বাউলের একতারার সুর মূর্ছনার পরিবর্তে করোনার হানায় হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে। করোনা যেন বদলে দিয়েছে লালনের শহরের আসল রূপ মাধুর্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কুষ্টিয়ায় লালন, বাউল, পদ্মাপুরান, নসিমন, ভাসান গানের শিল্পীর সংখ্যা ২ হাজারেরও অধিক। যাদের অধিকাংশেরই আয়ের উৎস সংস্কৃতি। কিন্তু করোনার কারণে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অধিকাংশ শিল্পীই মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ বিপর্যয় ভয়াবহ। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে রিকশা, অটো এবং ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্পীদের এ পেশায় আর ধরে রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে করোনাকালীন প্রণোদনার জন্য ১ হাজার শিল্পীর তালিকা পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ২৭৬ জন একেবারেই হতদরিদ্র। কিন্তু প্রণোদনার প্যাকেট মাত্র ১০০ জনের হাতে গেছে।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমির এডহক কমিটির পরিচালক সেলিম হক বলেন, বাউলরা একমাত্র সংগীতের ওপরই নির্ভরশীল। তাদের দৈনন্দিন আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই পথে বসেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রণোদনা পেলেও অধিকাংশই পায়নি। ফলে নিরুপায় হয়ে পেশা বদল করছে কেউ কেউ। কিন্তু অনেকের পুঁজি নেই বলে কোনো কাজও করতে পারছে না। এমনও অনেক শিল্পী আছে যারা এক বেলা খেতে পেলেও অন্য বেলায় উপোস করেই কাটাচ্ছে। এদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার দাবি জানাচ্ছি।
বিশিষ্ট বাউল শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া বলেন, এখনো আমি গান গেয়ে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দিচ্ছেন। আর আমার ওষুধ কিনতেই লাগে ১৫ হাজার টাকা। ওষুধ কিনব নাকি খাব? এখন খুব কষ্টে দিন কাটছে। আমি শিল্পী, গান ছাড়া আমার আর কিছু নেই। আমি গান গেয়ে বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচতে দিন।
কুষ্টিয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাহিন সরকার বলেন, কুষ্টিয়ায় সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড ৭ মাস ধরে পুরোপুরিই বন্ধ থাকার ফলে যারা নাটক, নৃত্য, সংগীতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ সরকারি প্রণোদনা পেয়েছে। কিন্তু ৫ হাজার টাকায় ৭ মাসের বোঝা টানা মুশকিল। অনন্যোপায় হয়ে কেউ কেউ পেশাও বদলে ফেলছে। যারা সংগীত পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তারা কি এ পেশায় আর ফিরবে? বিষয়টা ভেবে দেখা দরকার।
কুষ্টিয়া নৃত্য রং একাডেমির পরিচালক মাহাবুব শাহরিয়া বাদল বলেন, কুষ্টিয়ার স্থবির সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এর শিল্পীদের অবস্থাও স্থবির এবং করুণ। অনেকে আছে পেশা বদল করছে, আবার অনেকে অন্য পেশায় যেতেও পারছে না। কারণ দীর্ঘদিনের এ পেশা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনো অপশনও নেই। ফলে তারা যে মানবেতর জীবনযাপন করছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়। এর থেকে তাদের উদ্ধার করা জরুরি। নইলে কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়বে।
পদ্মাপুরান গানের শিল্পী মিরাজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন এলাকায় মনবাসনা পুরণ কিংবা সর্পদংশন থেকে মুক্তি পেতে এই পদ্মাপুরান গারেনর আসর বসানো হয়ে থাকে। কিন্তু করোনাকালীন কোন গানের আয়োজন না থাকায় আমরা বিপদে পড়েছি। অন্য কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছি। বেশ কিছু দায়িক দেনায় রয়েছি বলেও জানান তিনি। তবে শিল্পী সমাজের মাঝে সরকারি প্রণোদনা ভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও তারা কোন এই পদ্মাপুরান এর সাথে সংশ্লিষ্টরা কোন ভাতা কিংবা সহযোগীতা পায়নি।
কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার মো. সুজন রহমান বলেন, কুষ্টিয়ায় শিল্পীদের বিপর্যয় খুব ভয়াবহ। অনেকে পেশা হারিয়ে পথে বসেছেন। আমরা ঢাকায় ১ হাজার শিল্পীর তালিকা পাঠিয়েছিলাম। এদের মধ্যে হতদরিদ্র ২৭৬ জন। যাদের সহযোগিতা না হলেই নয়। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে মাত্র ১০০ জনকে।
শিল্পীদের আত্মসম্মানবোধটা এতই বেশি যে লজ্জায় সাহায্যের জন্য কারো কাছে হাতও পাততে পারেন না। তারা কাজ করেই টাকা নিতে চায়। অনেকে ঋণ সহায়তা পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারত।
তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী পালা, নসিমন, গাজীর গান শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনোভাবেই আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। অনেকে মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। তাই এখনই এসব শিল্পীদের আর্থিক সহযোগিতা না দিলে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।