শিশুর সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারের বহুমূখী পরিকল্পনার একটি নজির ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন। একটা সময় ছিল যখন শিশুরা সন্ধ্যায় চোখে দেখতে পেত না। বিষয়টাকে মা-বাবা গুরুত্ব দিত না বা খেয়াল করত না। একপর্যায়ে জানতে পারলো তার শিশুকে সময়মতো চিকিৎসা করালে অন্ধত্বে ভুগতে হতো না।
বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্খিত পরিণতি এড়ানোর কথা মাথায় রেখে সরকার শিশুদের জন্য ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন নামে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে শিশুদের রাতকানা রোগ হয়। এই ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের প্রথম উপসর্গ হলো রাতকানা। এ ধরনের রোগীরা মৃদু আলোতে কম দেখে, সময়মত চিকিৎসা না হলে অন্ধ হয়ে যায়। এসব ছাড়াও ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, হাম, ডায়রিয়াসহ নানা কারণে মৃত্যুহার বেশি হয়ে থাকে। তাই ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত সমস্যা প্রতিরোধে সরকারিভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বছরে দু’বার জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন হয়ে থাকে। এতে ৬ থেকে ১১ মাস বয়সি সবশিশুকে একটি নীল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সি সব শিশুকে একটি করে লাল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। নীল রঙের ক্যাপসুলের মাত্রা ১ লক্ষ আইইউ (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট) এবং লাল রঙের মাত্রা ২ লক্ষ আইইউ।
(৪-১৭) অক্টোবর “জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন”। টীকাদান ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেশের ৬ মাস থেকে ১ বছরের কম বয়সি প্রায় ২৭ লক্ষ শিশুকে নীল রঙের ১টি করে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১ বছর থেকে ৫ বছর বয়সি প্রায় ১ কোটি ৯৩ লক্ষ শিশুকে লাল রঙের ১টি করে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। শিশু ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল পাবে। সরকারের লক্ষ্য হলো ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সি শিশুদের মাঝে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত রাতকানা রোগের প্রাদুর্ভাব এক শতাংশর নিচে নামিয়ে আনা। এছাড়া এসব শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা। ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন এর অর্থ হলো শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো ছাড়াও এই দিনে মায়েদের মাঝে স্বাস্থ্য বার্তাসমূহ প্রচার করা। যেহেতু ৬ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাবার খাওয়ানো সবক্ষেত্রে নিশ্চিতকরা সম্ভব হয় না, তাই সম্পূরক ভিটামিন হিসেবে এই ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়ে থাকে। মায়েদের জানা দরকার ভিটামিন ‘এ’ শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা প্রয়োজন হয় অল্প পরিমাণে। এটা শুধু শিশুদের নয় বড়োদেরও প্রয়োজন। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার স্থায়ী ইপি আই টিকাদান কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ভিটামিন- ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। স্বাস্থ্যকর্মী প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার এবং স্বাস্থ্যসেবীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
ভিটামিন ‘এ’ মানবদেহের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। প্রাণিজ উৎস হিসেবে কলিজা, ডিমের কুসুম, মাখন, পনির, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছের তেলে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ উৎসের মধ্যে সতেজ পাতাবহুল সবজি যেমন- পালং ও মেথিশাক, বাঁধাকপি এবং রঙিন সবজি যেমন গাজর, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ফল যেমন আম, পেঁপে থেকেও আমরা ভিটামিন ‘এ’ পেয়ে থাকি।
সরকার বাস স্ট্যান্ড রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বিমানবন্দরে, ফেরি ঘাট, ব্রিজ টোল প্লাজা এবং খেয়া ঘাটগুলোতে ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। কর্মসূচির আওতায় ১২টি জেলার ৪২টি উপজেলায় ২৪০ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের খুঁজে ক্যাম্পেইনের পরের চার দিন বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। এছাড়াও ক্যাম্পেইনটি সফল করতে মোট ২ লাখ ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পেইন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি উপজেলা, জেলা এবং সমস্ত কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে বলে সরকার আশা ব্যক্ত করেছেন।
ভিটামিন ‘এ’ এর প্রধান কাজ দেহবৃদ্ধি এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। চোখের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে ভিটামিন ‘এ’ কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ শিশুদের ম্যালেরিয়া, হাম এবং ডায়রিয়াজনিত জটিলতা কমিয়ে আনে। ডায়রিয়া হলে শিশুর দুর্বলতাসহ শরীরে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু ভিটামিন ‘এ’ ডায়রিয়ার ব্যাপ্তিকাল ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে এবং চোখের ছানি প্রতিরোধে ভিটামিন ‘এ’ এর ভূমিকা রয়েছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ভিটামিন ‘এ’ দেহের ত্বককে রক্ষা করে। ভিটামিন ‘এ’ ব্রণ, একজিমা, ফোঁড়া এবং ক্ষত সারাতে কাজ করে।
ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব পূরণে শিশুদের নিয়মিত ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ মাছ-মাংস, ফল, শাক-সবজি খাওয়ানো দরকার। শাক-সবজি অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে তেল দিয়ে রান্না করতে হবে। শুধু পানি দিয়ে সিদ্ধ করলে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যাবে না। পরিবারের রান্নায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্য তেল ব্যবহার করতে হবে। মা ও শিশুর পুষ্টির জন্য গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের।
-২-
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ রঙিন শাক-সবজি এবং হলুদ ফলমূল খাওয়া উচিত। শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিমাণমতো ঘরে তৈরি সুষম খাবার খাওয়াতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের অভাবে শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগে থাকে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর বৃদ্ধি ধীর গতিতে হয়ে থাকে ও প্রায়ই নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সরকারের লক্ষ্য হলো আগামী প্রজন্মকে সুস্থ-সবল ও নিরোগ দেহের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। আর এ কারণেই ক্যাম্পেইনে পুষ্টি-বার্তা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস। প্রতি ৬ মাস অন্তর সরকারের এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত রাতকানা রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করা গেলেও এটি অব্যাহত রাখতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সব ধরনের ভিটামিনযুক্ত খাবার থাকতে হবে।
(৪-১৭) অক্টোবর সকল কেন্দ্র সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। যদি কোনো শিশু গত চার মাসের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেয়ে থাকে তবে তাকে ক্যাম্পেইনে এ ক্যাপসুল খাওয়ানো যাবে না। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ভরাপেটে খাওয়ানো ভালো। এটি খাওয়ানো হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নেই। তবে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের বমি, পেটের পীড়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তবে এটা সাময়িক। এ ধরনের সমস্যা হলে শিশু বুকের দুধ ও খাবার স্যালাইন খাবে, প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর প্রয়াস অব্যাহত থাকুক। অন্ধত্বের হাত থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত থাকবে- এ প্রত্যাশা সবার।