আগামী বাজেটে (২০২১-২২) ভ্যাট আইনে কাঠামোগত বড় পরিবর্তন আসছে। আইনটি আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (অ্যাডভান্স ট্যাক্স বা এটি) হার কমানো হচ্ছে।
এছাড়া রিফান্ড জটিলতার কারণে কয়েকটি শিল্পকে আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ দুটোতেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পের স্বার্থে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়। আগাম করহার ছিল ৫ শতাংশ। চলতি বাজেটে স্থানীয় শিল্পের চলার পথ মসৃণ করতে আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের ওপর আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়।
প্রসঙ্গত, পুরোনো আইনে আগাম করকে অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট বা এটিভি বলা হতো। তখন মোটা দাগে, শুধু বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের এটিভি দিতে হতো। উৎপাদনমুখী শিল্প এটিভির আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু নতুন আইনে কয়েকটি ছাড়া সব ধরনের শিল্পকে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর দিতে হচ্ছে। এ কর ফেরত (রিফান্ড) দেওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় উদ্যোক্তারা সময়মতো সেটি পাচ্ছেন না। এ নিয়ে শিল্প মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছেন।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভ্যাটের কমপ্লায়েন্স বাড়াতে আগাম করপ্রথা চালু করা হয়। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান যেন ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে সেজন্য সব শিল্পকে আগাম করের আওতায় আনা হয়। কিন্তু যথাসময়ে রিফান্ড দিতে না পারায় পদ্ধতিটি সমালোচনার মুখে পড়েছে। এসব বিবেচনায় আগামী বাজেটে আগাম করহার ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, অনেক খাতকে বাজেটে আগাম করের আওতার বাইরে রাখা হচ্ছে। যেমন ব্যবসায়ী পর্যায়ে মোবাইল ফোন সেট ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আগাম কর অব্যাহতি না দেওয়ায় রিফান্ড সৃষ্টি হচ্ছে।
একইভাবে স্টিল স্ক্র্যাপ, শিপ স্ক্র্যাপ, রডের ওপর টনপ্রতি এক থেকে ২ হাজার টাকা সুনির্দিষ্ট ভ্যাট আরোপিত আছে। অথচ আমদানি পর্যায়ে আগাম কর রয়েছে এবং যথারীতি রিফান্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া সিমেন্ট, বেভারেজ ও সিরামিক খাতের মতো উৎপাদন পর্যায়ে যেসব শিল্পে মূল্য সংযোজনের হার ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশের কম, সেসব ক্ষেত্রে রিফান্ড সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রদেয় ভ্যাট থাকে না। তাই আগামী বাজেটে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, মোবাইল ফোন, সিমেন্ট ও স্টিল শিল্পকে আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে।
এ বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ফিকি) সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, আগাম কর কমানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এটি পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ এই টাকা পরে ফেরত পেতে নানা ঝামেলা হয়।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ব্যবসায় আগাম কর থাকাই উচিত না। এ কর আদায় করে ফেরত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। যদি ফেরতই দেওয়া হয়, তাহলে আদায় করা দরকার কী। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। এখন ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়ে বাঁচাতে হবে। সামান্য ছাড় দিয়ে উৎসাহ দিলে চলবে না। আগাম করের খক্ষ বড়রা হজম করতে পারলেও ছোটরা পারছে না।
গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান বলেন, কোনো কর অগ্রিম নেওয়ার যৌক্তিকতাই নেই। হোক সেটা অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বা আগাম কর (এটি)। এ করোনা পরিস্থিতিতে সেটা তো আরও ভয়াবহ।
অগ্রিম কর নেওয়া হলে ব্যবসার ক্যাশ ফ্লো কমে যায়। তখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকার একদিকে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিচ্ছে, অন্যদিকে অগ্রিম করও আদায় করছে। এ প্রেক্ষাপটে অগ্রিম সব ধরনের কর আদায় বন্ধ রাখা উচিত।
অন্যদিকে ভ্যাট আইনে ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ হার দুটোই কমানো হচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাট ফাঁকির ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ফাঁকির সমপরিমাণ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দেওয়ায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটি বাজেটে এক শতাংশ করা হচ্ছে।
এছাড়া দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পের (এসি-ফ্রিজ) ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রজ্ঞাপনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বাজেটে শর্তসাপেক্ষে এ সুবিধার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সাল থেকে রেফ্রিজারেটর ও মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে সরকার। চলতি বাজেটে মোটরসাইকেলকে এ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে শুধু এসি-ফ্রিজ এবং কম্প্রেসার উৎপাদন শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে।