ত্বকের ঠিক নিচের শিরাগুলো যখন মোটা হয়ে ফুলে উঠে একেবেঁকে সর্পিলভাবে অগ্রসর হয়, তখন তাকে ভ্যারিকোস ভেইন বলা হয়। ভ্যারিকোস ভেইন মূলত পায়ে হলেও শরীরের অন্য স্থানেও হতে পারে।
এমনটি হলে মাঝে মাঝে শরীর বেশ চুলকায়। দেখতেও বিশ্রী। অনেক সময় অস্ত্রোপচার করা লাগে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার।
ত্বকের নিচে অবস্থিত পায়ের সবচেয়ে বড় শিরা- লং স্যাফানাস ভেইন (Long saphenous Vein) এবং এর উপশাখাগুলো এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। পায়ের পাতার উপরিভাগ এবং গোড়ালি ও পায়ের ভেতরের দিক থেকে শুরু হয়ে ওপরে উরুর ভেতরের দিকে এসব আঁকাবাঁকা শিরাগুলোর শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হয়। ‘শর্ট স্যাফানাস ভেইন’ (Short saphenous Vein) নামে পায়ের অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি শিরা ও তার উপশাখাগুলোও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এদের বিস্তৃতি মূলত হাঁটু ও পায়ের পেছন বা বাইরের দিকে।
ভ্যারিকোস ভেইনের উপসর্গ
ভ্যারিকোস ভেইন দৃষ্টিকটু একটা রোগ। সঙ্গত কারণেই এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষ করে মহিলারা তাদের আক্রান্ত পা নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। প্রাথমিক অবস্থায় পায়ে ব্যথা অনুভূত হয়, পা ভারী বোধ হয় এবং হাঁটতে ক্লান্তি লাগে। পরবর্তী সময়ে পায়ের আক্রান্ত অংশ ফুলে যায়, অল্প আঘাতে ফুলে যাওয়া শিরা থেকে রক্তক্ষরণ হয়, শুকনো বোধ হয়, চুলকায় ও আক্রান্ত অংশের চামড়ার রং কালো হয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে আক্রান্ত অংশে ঘা হয়, যা সহজে শুকাতে চায় না বা শুকালেও আবার দেখা দেয়।
ভ্যারিকোস ভেইনের সম্ভাব্য জটিলতা
ভ্যারিকোস ভেইন থেকে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা অপেক্ষাকৃত কম। ক্ষেত্রবিশেষে নিচের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে-
* আক্রান্ত শিরাগুলো থেকে বারবার রক্তক্ষরণ হতে পারে।
* সময়মতো চিকিৎসা না করালে ভ্যারিকোস ভেইন থেকে সৃষ্ট চুলকানি ও ত্বকের নিচে জমা হতে থাকা রক্তের লৌহজাত উপাদান থেকে ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
* আক্রান্ত শিরাগুলোর ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে কখনও কখনও হঠাৎ তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে।
* শিরার ভেতরে জমাট বাঁধা এ রক্ত ছুটে গিয়ে ফুসফুসে আটকাতে পারে, যার কারণে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে যদিও এ আশংকা খুব কম।
* ভ্যারিকোস ভেইন থেকে সৃষ্ট ঘা ক্ষেত্রবিশেষে ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে।
ভ্যারিকোস ভেইন কেন হয়
পায়ের শিরার কথা যদি ভাবি, তাহলে দেখা যায়, স্বাভাবিক নিয়মে এ শিরার ভেতর দিয়ে রক্ত নিচ থেকে ওপরের দিকে অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে প্রবাহিত হয়। শিরার ভেতরে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ’ভাল্ব’ বা ’কপাটিকা’ থাকে। রক্ত যেহেতু তরল, এর স্বাভাবিক প্রবণতা হল নিচের দিকে প্রবাহিত হওয়া। পায়ের মাংসপেশির সংকোচন বা মাসল পাম্প (Muscle Pump) ও শিরার ভাল্বগুলো শিরার ভেতর দিয়ে প্রবাহমান তরল রক্তের এ সম্ভাব্য নিম্নমুখী প্রবাহকে প্রতিহত করে ও এর ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহকে নিশ্চিত করে। ভ্যারিকোস ভেইনে আক্রান্ত শিরার পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাল্বের (কুচকির কাছে সেফানো-ফেমোরাল জাংশান অথবা হাঁটুর পেছনে সেফানো-পপলিটিয়াল জাংশান) কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে রক্তের স্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ বিঘ্নিত হয় ও রক্ত নিচের দিকে নেমে যেতে থাকে। ফলে শিরার ভেতরে রক্তের চাপ বেড়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে শিরাগুলো ফুলে গিয়ে ভ্যারিকোস ভেইনের সৃষ্টি করে। কেন শিরার এ ভাল্ব বা কপাটিকার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও নিম্নলিখিত ব্যাপারগুলোর ভূমিকা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
* শিরার দেয়ালের গঠনে জন্মগত দুর্বলতা।
* বেশি ওজন ও বেশি বয়স।
* সন্তান ধারণ।
* দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকা।
এর সব ভ্যারিকোস ভেইনের কারণ না হলেও এরা সমস্যাকে প্রকট করে তুলতে পারে।
চিকিৎসা
প্রাথমিক পর্যায়ে অপারেশন ছাড়াই ভ্যারিকোস ভেইনের চিকিৎসা বা কমপক্ষে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এ পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে-
* পা উঁচুতে রাখা
* একটানা দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে বা বসে না থাকা
* বিশেষ ধরনের মোজা ও বিশেষ কিছু ওষুধ ব্যবহার করা।
একটা পর্যায়ে ভ্যারিকোস ভেইনের চিকিৎসায় অপারেশন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মূলত দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে-
সনাতন পদ্ধতির অপারেশন : এ অপারেশনে কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে আক্রান্ত ফুলে যাওয়া শিরাগুলো তুলে ফেলা হয় ও রোগের কারণও নির্মূল করা হয়। রোগের বিস্তার খুব বেশি হলে সব জায়গায় কাটাছেঁড়া না করে কোনো কোনো জায়গায় ফুলে যাওয়া শিরার ভেতরে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে এগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ চিকিৎসা পদ্ধতি স্কেলেরোথেরাপি (Sclerotherapy) নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এসব শিরা ধীরে ধীরে চুপসে যায়।
লেজার (Endovenous Laser Ablation) ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (Radio-Frequency Ablation) : এটাই ভ্যারিকোস ভেইন চিকিৎসার আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়া না করেই রোগের কারণ নির্মূলে লেজার বা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফুলে যাওয়া শিরাগুলো নির্মূলে প্রয়োজনে স্কেলেরোথেরাপির সাহায্য নেয়া হয়। কাটাছেঁড়া করতে হয় না বলে উন্নত বিশ্বে লেজার এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এসব পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
ফুলে যাওয়া শিরাগুলোও যেহেতে রক্ত চলাচলের একটা পথ, প্রশ্ন উঠতে পারে যে ওগুলো ফেলে দিলে বা বন্ধ করে দিলে রক্ত চলাচলে অসুবিধা হতে পারে কিনা। এর উত্তর- ‘না’। কারণ প্রথমত ফুলে আঁকাবাঁকা হয়ে যাওয়া শিরাগুলো এমনিতেই রক্ত চলাচলে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। দ্বিতীয়ত, মানবদেহের মাংসের গভীরে আরও মোটা শিরা বা ডিপ ভেইনস (Deep Veins) রয়েছে। রক্ত পরিবহনে এদের ভূমিকাই মুখ্য। তাই ত্বকের নিচের ফুলে যাওয়া শিরাগুলো ফেলে দিলেও কোনো অসুবিধা হয় না। মাংসের গভীরে বিন্যস্ত এ শিরাগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা- অপারেশনের আগেই তা বিশেষ একটি পরীক্ষার (ভাস্কুলার ডপ্লার বা ডুপ্লেকক্স) মাধ্যমে দেখে নেয়া জরুরি। অন্যথায় ভ্যারিকোস ভেইনের অপারেশন করা নিয়মসিদ্ধ নয়। ভ্যারিকোস ভেইনের অপারেশন ও তার পূর্ববর্তী মূল্যায়ন একজন অভিজ্ঞ রক্তনালির সার্জনের হাতেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেজার বা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন নাকি সনাতন পদ্ধতির অপারেশন
ভ্যারিকোস ভেইন চিকিৎসায় ওপরে বর্ণিত সব পদ্ধতিই কার্যকর। লেজার এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের বড় সুবিধা হল কাটাছেঁড়া করতে হয় না বলে অপারেশনের তুলনায় সুস্থ হতে রোগীর সময় বেশ কম লাগে। এ মুহূর্তে আমাদের দেশে লেজার বেশ ব্যয়বহুল এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। লেজার চিকিৎসার পর অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানে বা তার আশপাশে ভ্যারিকোস ভেইন আবারও দেখা দিতে পারে। সেই তুলনায় সনাতন শল্য চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সবার জানা। সঠিকভাবে করা হলে এ অপারেশনের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় স্থায়ীভাবে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। আমাদের দেশে ভ্যারিকোস ভেইনের রোগীরা যখন চিকিৎসা নিতে আসেন, রোগ তার আগেই অনেক বেশি বিস্তৃতি লাভ করে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে কিছু কাটাছেঁড়া প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়ে।