মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম মাদক ব্যবসার নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তেঁতুলবাড়িয়া, খাস মহল, রংমহল, সহড়াতলা, কল্যানপুর, নওদাপাড়া, পলাশীপাড়া, মথুরাপুর, করমদি গ্রামের বেশ কিছু পরিবারের সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসার সাথে। গাঁজা, ফেন্সিডিল, মদ সহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য ভারত থেকে এনে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র থেকে জানা যায়, নির্দিষ্ট কমিশন দিয়ে ভারত থেকে মাদক দ্রব্য আনা হয়। প্রতি ১০০ বোতল ফেন্সিডিল আনতে কমিশন হিসেবে দিতে হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। প্রত্যেক ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা নিয়ে ম্যানেজ করা হয় কিছু প্রশাসনের লোকদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহড়াতলা গ্রামের আজের আলীর ছেলে লাইনম্যান বাদশা ও তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের মৃত আকেববার আলীর ছেলে এলাকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা মোখলেছুর রহমান মোখলেছ ঐ এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এলাকার চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী হিসেবেও পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে মোখলেছ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে মেহেরপুর প্রতিদিনকে জানান, আমি একজন রাজনৈতিক নেতা। আমার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ উঠেছে সেটা সঠিক না।
এছাড়াও এক বা একাধিক মাদক মামলার পলাতক আসামী এখনো চুটিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, করমদি গ্রামের আফেল উদ্দিন এর ছেলে আব্দুল হান্নান। যার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা ও তিনটি মাদক মামলা রয়েছে। পুলিশের ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
সহড়াতলার হারুন-অর-রশিদ এর ছেলে মাদান। ২০১৬ সালে ১১২ পিচ ভারতীয় শাড়ি সহ মাদান আটক হয়। শাড়ী চোরাচালান এর দায়ে গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
সহড়াতলা গ্রামের আজের আলীর ছেলে বাদশা। সে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে। ২০১২ সালে ১২ বোতল ফেন্সিডিলসহ পুলিশের হাতে ধরা খায়। এরপর জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় মাদক ব্যবসার মুল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে।
কল্যানপুর গ্রামের সামসুল এর ছেলে শরিফুল। যার বিরুদ্ধে গাংনী থানায় ২টি মাদক মামলা আছে। ২০১৮ সালে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে ৫৯ বোতল ফেন্সিডিলসহ আটক হয়। একই সাথে নজরুল এর ছেলে রুবেলও আটক হয়।
নওদাপাড়ার মেহের শেখ এর হামিদুল। ২০১২ সালের মারামারি মামলার আসামী। এখন সে ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী।
মথুরাপুরের রবিউল এর ছেলে রজব। এবছর মার্চ মাসের ৭ তারিখে ১৮ বোতল ফেন্সিডিল সহ আটক হয়। তার বিরুদ্ধে গাংনী থানায় ২ টি মাদক মামলা আছে।
মৃত ওয়াজিল শেখ এর ছেলে কালু। তার বিরুদ্ধে ২ টি মাদক মামলা আছে। পলাশীপাড়ার গোলাম রসুল ওরফে ফড়ুর ছেলে সেলিম। ২০১০ সালে স্বর্ন চুরি মামলায় আটক হয়।নখাসমহলের মৃত চাঁন্দর ছেলে মফিজ। তার বিরুদ্ধে ৩টি মাদক সহ গাংনী থানায় ৪টি মামলা আছে।
এছাড়াও সহড়াতলার আতর আলীর ছেলে আসাদুল, মথুরাপুরের মৃত ইব্রাহীম এর ছেলে সাইদ, মৃত কামাল খাঁ এর ছেলে আশরাফ, তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের জানালির ছেলে মোসা, মনিরুল ফকির এর স্ত্রী রাহিমা, সামেক উদ্দিন এর ছেলে রহিম।
বেশ কিছু চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে হারান শেখ এর ছেলে লোকমান। চলতি বছর জুলাই মাসে ৫০ বোতল ফেন্সিডিল সহ আটক হয়। তার বিরুদ্ধে গাংনী থানায় মাদক মামলা আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ব্যাক্তি জানান, এলাকার প্রভাবশালী নেতা মখলেছ ও লাইনম্যান বাদশার নেতৃত্বে চলছে মাদক ব্যাবসা। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সরাসরি ভারত থেকে মাদক নিয়ে আসছে। রাতে ভারত থেকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে সকালের ভিতর বিভিন্ন মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌছে দেওয়া হয়। বড় বড় চালান আসলে সেগুলো বিভিন্ন যান বাহনে করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হয়।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ি ২০১৯ সালের শুধু ডিসেম্বর মাসেই ১৬ জন মাদক ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মাদক দ্রব্যসহ আটক করা হয়েছে। সেই সাথে মাদক সেবনের অপরাধে ২ জনকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
এরপরও কিন্তু থেমে যায়নি মাদক ব্যবসা। মামলায় আটক করা হলেও আদালত থেকে জােিন মুক্ত হয়ে যায় আসামীরা। ফিরে এসে আবার শুরু মাদক ব্যবসা। কেনইবা থামানো যাচ্ছে না মাদক ব্যবসাকে, দুর্বলতা কোথায়, এ ব্যর্থতার দায় কি শুধু প্রশাসনের নাকি অন্য কারও, এমন প্রশ্ন এলাকার সচেতন মহলের?
সহড়াতলা বিজিবি ক্যাস্প কমান্ডার খায়রুজ্জামান বলেন, আমি সবে মাত্র এখানে যোগদান করেছি। তারপরও নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আপনারা জানেন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার মাদক দ্রব্য আটক করেছি। যারা এর সাথে জড়িত তাদেরকেও আটক করে আইনের আওতায় হবে।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবাইদুর রহমান বলেন, মাদক এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করা হয়েছে। যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদক নির্মুলে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে গাংনী থানা পুলিশ এবং সে মোতাবেক আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ওসি রবিউল ইসলাম জানান, আমরা মাদক মুক্ত মেহেরপুর গড়তে বদ্ধ পরিকর। আপনারা জানেন প্রতিনিয়ত জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। ইতি মধ্যে মাদক সম্রাটদের আটক করে তাদের চালান দেওয়া হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। (চলবে)
-বিশেষ প্রতিনিধি