মালয়েশিয়ার সফল ব্যক্তিদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি ড. মোহাম্মদ নাজমুল হাসান মাজিজ। তার জীবনী যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশপেডিয়ার “সাক্সেসফুল পিপল্ ইন মালয়েশিয়া’’ শীর্ষক বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে।
বইয়ের প্রথম সংস্করণটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় সংস্করণটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল। ড. নাজমুলের জীবনী প্রকাশিত হয়েছিল উভয় সংস্করণে।
এই বইয়ে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ডা. মাহাথির মোহাম্মদসহ মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, গভর্নর, বিশিষ্ট ব্যবসায়ির নাম রয়েছে। সফল ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার মানদণ্ডটি হলো তাদের অসামান্য একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক কৃতিত্ব, সমাজে তাদের অবদান, বিশ্বে অবদান ইত্যাদি।
ড. নাজমুল একজন শিক্ষাবিদ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানী। বর্তমানে তিনি তার পরিবারসহ মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের পেরদানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ মেডিসিনের ডেপুটি ডিন, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড রিসার্চ ফেলো হিসাবে কাজ করছেন। তিনি শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম কমিটির প্রধান, বিভাগীয় প্রধান, মাস্টার্স অফ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের প্রধান। মেডিকেল সায়েন্টিস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। পেরদানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি মালয়েশিয়ার সরকারী এবং বেসরকারী উভয় বিশ্ববিদ্যালয়েই কাজ করেছেন। তিনি ডক্টর অফ মেডিসিন (এমডি), এমবিবিএস, ব্যাচেলর অফ ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস), ব্যাচেলর অব বায়োমেডিকাল সায়েন্সেস (বিবিএমএস), ব্যাচেলর অব অপ্টোমেট্রি, এমএসসি ইন পাবলিক হেলথ, এমএসসি মেডিকেল সায়েন্সেস এবং পিএইচডির মতো বিভিন্ন প্রোগ্রামের শিক্ষকতায় জড়িত ছিলেন। মালয়েশিয়ায় ২৫০০ জনের ও বেশি চিকিৎসক (মেডিকেল ও ডেন্টাল) তৈরিতে তার অবদান রয়েছে। মালয়েশিয়ার এমবিবিএস, বিডিএস, বিবিএমএসসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের কারিকুলাম উন্নয়নে এবং প্রোগ্রাম অনুমোদনে তার অবদান রয়েছে।
ড. নাজমুল মূলত বাংলাদেশের কুমিল্লার বাসিন্দা এবং তার বাবা মো. মাজিজুল ইসলাম (মরহুম) এবং মা শাহানারা বেগম পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কুমিল্লার কালিয়াজুরীতে বসবাস করতেন। তার জন্ম ১৯৭৬ সালে। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিল কুমিল্লার ইবনে তাইমিয়া স্কুল। তিনি ১৯৯১ সালে কুমিল্লা হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন এবং স্কুলজীবনে তিনি কুমিল্লা হাই স্কুলের সেরা ছাত্র হিসেবে ভূষিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স, ভারতের মণিপালের কস্তুরবা মেডিকেল কলেজ থেকে মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিতে এমএসসি পাস করেছেন। পরে তিনি উচ্চতর পড়াশুনার জন্য মালয়েশিয়া যান এবং ২৮ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অফ মালায়া, মালয়েশিয়া থেকে মলিকুলার মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার পিএইচডি গবেষণা প্রকল্পের শিরোনাম ছিল ‘ডিটেক্সন এণ্ড মলিকুলার কারাক্টারাইজেশন অফ ভেরোটক্সিন ইন এন্টারোপ্যাথোজেনিক এস্চেরসিয়া কোলাই এণ্ড নন-০১৫৭ ডায়রিয়াজেনিক এস্চেরসিয়া কোলাই। পিএইচডি শেষ করার পরে, ২০০৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা (ইউআইটিএম) তে মেডিসিন ফেকাল্টি মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজির প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি তার মেধার গুণে খুব দ্রুত সিনিয়র প্রভাষক এবং তারপরে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন এবং তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। এখানে উল্লেখ করার বিষয়, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা মালয়েশিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়, যার ছাত্র সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। ইউআইটিএম থেকে তিনি ২০১৫ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সেগী ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করেন। ২০১৮ সালে তিনি পেরদানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
ড. নাজমুল দুই শতাধিক একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক সার্টিফিকেট পেয়েছেন। তিনি দুটি মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক বইয়ের লেখক। প্রথম বইটির শিরোনাম “ভেরোটক্সিন” এবং দ্বিতীয় বইয়ের শিরোনাম “অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স”। যারা মলিকুলার বায়োলজি, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজি বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে চান তাদের জন্য বইগুলি দরকারী। দুটি বইই ইউরোপে প্রকাশিত হয়েছে এবং অ্যামাজন ডট কমসহ অন্যান্য অনলাইন স্টোরে বিক্রি হচ্ছে। তার আরও দুটি বই প্রকাশের পথে।
ড. নাজমুল একজন অত্যন্ত সুপরিচিত চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তার গবেষণা সাধারণত ইনফেকশাস ডিজিজ এণ্ড পাবলিক হেল্থ এর উপর। মলিকুলার টেকনিক, মলিকুলার কারাক্টারাইজেশন, প্লাজমিড এবং ক্রোমোজোমাল ডিএনএ এক্সট্রাকশন, ইলেক্ট্রোফোরসিস, জেল পিউরিফিকেশন, পিসিআর, হাইব্রিডাইজেশন, ডিএনএ প্রোব প্রিপারেশন, ব্যাকটিরিওফেজ ইনডাকশন, ক্লোনিং, রেস্ট্রিকশন এনজাইম এনালাইসিস, সিকোয়েন্সিং এণ্ড এনালাইসিস, প্রাইমার ডিজাইনিং, এনিমেল পেথোজেনিসিটি টেস্টিং, এমআইসি টেস্টিং, অ্যান্টিবায়োটিক সেন্সিটিভিটি টেস্টিং, এলাইজা, ইমিউনোফ্লোরসেন্স, মাইক্রোস্কোপি, টিস্যু কালচার, ব্যাকটিরিয়াল ভাইরাল পেরাসাইটিক এণ্ড ফাঙ্গাল ডায়াগনোসিস, এপিডেমিওলজি ইত্যাদিতে তিনি পারদর্শী। তিনি মালয়েশিয়ার সরকার থেকে ১ কোটিরও বেশি টাকা গবেষণার জন্য অনুদান পেয়েছেন। তিনি অনেক স্নাতক, মাস্টারস্ এবং পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রকল্পের জন্য সুপারভাইজ করেছেন।
ড. নাজমুল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে ৮০টিরও বেশি গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জার্নাল হলো: ইউরোপীয়ান জার্নাল অফ মলিকুলার এণ্ড ক্লিনিকাল মেডিসিন, মালয়েশিয়ান জার্নাল অফ পাবলিক হেল্থ এন্ড মেডিসিন, পাকিস্তান জার্নাল অফ মেডিকেল এন্ড হেল্থ সায়েন্সেস, বাগদাদ সায়েন্স জার্নাল, ইরান জার্নাল অফ পাবলিক হেল্থ, জর্ডান জার্নাল অফ বায়োলজিকাল সায়েন্সেস, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফার্মাসিউটিকেল রিসার্চ, অকুপেশনাল ডিজিজেস এন্ড এনভাইরনমেন্টাল মেডিসিন, ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পাবলিক হেল্থ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট, রিসার্চ জার্নাল অফ মেডিকেল সায়েন্স, বাংলাদেশ জার্নাল অফ মেডিকেল সায়েন্স, পাকিস্তান জার্নাল অফ নিউট্রিশন, মিডেল-ইস্ট জার্নাল অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ, বায়োমেডিকাল রিসার্চ, আফ্রিকান জার্নাল অফ মাইক্রোবায়োলজি রিসার্চ, জার্নাল অফ এনিমেল এণ্ড ভেটেরিনারি অ্যাডভান্সস ইত্যাদি।
ড. নাজমুল আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত প্রভৃতি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনেক গবেষণা নিবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। তিনি বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছেন। ড. নাজমুল মালয়েশিয়ার স্থানীয় ‘দ্যা স্টার’ দৈনিক ইংরেজি পত্রিকার নিয়মিত লেখক। তার আর্টিকেলগুলি মূলত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কিত। তিনি অনেক আন্তর্জাতিক জার্নালের সম্পাদক এবং পর্যালোচক। তিনি মণিপাল এলুমনাই সায়েন্স এন্ড হেল্থ জার্নালের প্রধান সম্পাদকও। তিনি ‘মালয়েশিয়ান সোসাইটি অফ প্যারাসিটোলজি অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন’ এর সদস্য ছিলেন। তিনি জাতীয়ভাবে বিভিন্ন গবেষণা ও পোস্টার উপস্থাপনার বিচারক হয়েছেন। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ব্যাচেলর, মাস্টারস্ এবং পিএইচডি থিসিসের পরীক্ষক।
ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে, তিনি কোভিডের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন করার জন্য অনেক আর্টিকেল লিখেছেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলছেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় টিভি চ্যানেল তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে প্রচার করে।
শৈশবকাল থেকেই ড. নাজমুল বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তিনি উচ্চ ফিদে (ওয়ার্ল্ড দাবা ফেডারেশন) রেটিংসহ খুব ভাল দাবা খেলোয়াড়। তিনি বিভিন্ন জেলা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের দাবা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ, ভারত ও মালয়েশিয়ার অনেক চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার জিতেছেন। তিনি বহু বছর ধরে মালয়েশিয়ার আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র থাকাকালীন কয়েক বছর ধরে ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টার-ভার্সিটি দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ’ এর জন্য ইউনিভার্সিটি অফ মালায়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা’র দাবা কোচ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ, ভারত এবং মালয়েশিয়ার ক্যারম প্রতিযোগিতায় অনেক চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি খুব ভাল স্নুকার খেলোয়াড় এবং ভারত এবং মালয়েশিয়ার স্নুকার এবং পুল প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার জিতেছিলেন।
ড. নাজমুল বাংলাদেশের চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, আমাদের মোটেই সাফল্যের পিছনে ছোটা উচিত নয়। আমাদের কেবল মনোযোগ এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করা দরকার। আমরা যদি এগুলো অনুসরণ করি তবেই জীবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাফল্য আসবে।