শোকের মাসে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বড় ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেন না। স্বাভাবিকভাবে রুটিন কার্যক্রমগুলো চলে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও বড় ধরণের কোন কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়না। শোকের মাস শেষে চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু বড় ধরণের পদক্ষেপ নেবেন বলে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র ইঙ্গিত করেছে এবং সেখানে সরকারে একটি বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলেও আভাস পাওয়া গেছে।
আগামি কাল ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। পাশাপাশি দলীয় বেশ কিছু চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত আসতেও পারে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
মন্ত্রিসভার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে আলোচনায় আছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন ও কেন্দ্রীয় সদস্য বদরুদ্দিন আহমেদ কামরান মারা যাওয়ায় তিনটি পদ শূন্য হয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আরও কিছু পদ শূন্য রয়েছে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফকে সভাপতি মণ্ডলীর সদস্যসহ কয়েকজনকে এ পদে ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হতে পারে বলে গুঞ্জন চাউড় উঠেছে।
কয়েক মাস ধরে মন্ত্রিসভায় রদবদল হচ্ছে হচ্ছে করেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে এখন মন্ত্রিসভার রদবদলের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলেই আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এটা একটি বড় ধরণের রদবদলে রূপ নিতে পারে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই যে সমস্ত মন্ত্রীদের নিয়ে বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন তাদের কার্যক্রম, তারা গত দেড় বছরে কি কি সাফল্য এবং ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন সেই সম্পর্কে পূর্ণাংগ রিপোর্ট গ্রহণ করেছেন। কিছু কিছু মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ এসেছে সেগুলো প্রধানমন্ত্রী খতিয়ে দেখেছেন। এই সমস্ত পর্যালোনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র আভাস দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে যে, আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’কে দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগ তাদের ‘এ টিম’ কে নামাবে। অন্য একটি সূত্র বলছে যে, এটা আসলে বি টিম নয়। ২০০৯ এর মন্ত্রিসভাটা ছিল আওয়ামী লীগের বি টিম। এবার যে মন্ত্রিসভা হয়েছে তা আসলে আওয়ামী লীগের ‘সি টিম’। এবার আওয়ামী লীগে যে পরিবর্তন হবে তাতে আওয়ামী লীগের যারা যোগ্য, পারফর্ম করতে পারেন এসমস্ত লোকদেরকেই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে এই মন্ত্রিসভার পরিবর্তন কবে বা কিভাবে হবে সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরীকে অত্যন্ত সরব দেখা গেছে, বিশেষ করে করোনা সঙ্কটের সময় তাঁর ভূমিকা দলের ভেতরে এবং দলের নীতিনির্ধারক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যক্রমে খুশী বলে একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন। মতিয়া চৌধুরী তিন দফা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৮ থেকে টানা ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে সফল মন্ত্রী হিসেবে ছিলেন এবং এই কারণে মন্ত্রিসভায় তিনি ফিরে আসতে পারেন এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
শুধু বেগম মতিয়া চৌধুরী নয়, আমির হোসেন আমুরও মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে আসলে তারা মন্ত্রিসভায় ফিরবেন কিনা এই সম্পর্কে নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর একটি আনকোরা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কারণ তখনকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সেসময়ে পুরো দেশ এবং সরকার মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার অর্ধশত বছর উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান চিন্তা ছিল মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকে ঘিরে। এখন করোনা সংক্রমণের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন যে, যারা কাজ করতে পারবেন, যারা সরকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন তাঁদেরকে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এই কারণে সাইডলাইনে বসে থাকা হেভিওয়েটদের নিয়ে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে বলে একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছে।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর এই মন্ত্রণালয় এখন মন্ত্রীশূন্য। এ অবস্থায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এ মন্ত্রণালয়কে ঘিরেই মূলত এ রদবদলের গুঞ্জন ডালপালা ছড়াচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী আরও কিছু রদবদল করতে পারেন। সূত্র জানায়, নতুন মুখ হিসেবে ঢাকার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য ও উত্তরাঞ্চল থেকে একজন নতুন মন্ত্রিসভায় যুক্ত হতে পারেন। সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ নেতার নামও শোনা যাচ্ছে এ তালিকায়। এ ছাড়া কয়েকটি বড় মন্ত্রণালয়ে রদবদল হতে পারে। করোনার সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে।
এ মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এর বাইরেও রদবদলের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে। তবে মন্ত্রিসভায় রদবদলের পুরো এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি চাইলেই কেবল মন্ত্রিসভায় রদবদল বা নতুন মুখ আসা সম্ভব।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশি আলোচিত। এ ছাড়া বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো মন্ত্রণালয়েও পরিবর্তনের আভাস আছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের সময় অন্য দুয়েকটা মন্ত্রণালয়ে সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন হতে পারে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত বছর ৬ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যাদের মধ্যে ২৭ জনই প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় স্থান পান।
মন্ত্রিসভায় প্রথম পরিবর্তন হয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে চার মাসের মাথায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে। এরপর ১২ জুলাই ইমরান আহমেদকে প্রতিমন্ত্রী থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী এবং ফজিলাতুন নেসাকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে গণপূর্তের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খানকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
উল্লেখ্য যে, সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিসভার গঠন এবং এর রদবদল করার একক এখতিয়ার একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রী যখন বিবেচনা করবেন, তখনই তিনি মন্ত্রিসভায় রদবদল করতে বলবেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেই মন্ত্রিসভার রদবদলের জন্যে এক ধরণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে এবং এই নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে গুঞ্জনও কম নেই।