সময়ের নিরন্তর প্রবাহে থামতে হয় কখনো প্রয়োজনে, কখনো অপ্রয়োজনে। এরই মাঝে ঘটে যায় বহু ঘটনা। যা রয়ে যায় স্মৃতি হয়ে। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে হয় জীবনের প্রয়োজনে। না হলে জীবনটা হয়ে ওঠে নিরানন্দময়। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ বলেছেন “জীবনে কিছু কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর কখনো মিলেনা, কিছু কিছু ভুল থাকে যা শোধরানো যায়না, আর কিছু কিছু কষ্ট থাকে যা, কাউকে বলা যায়না”।
কথাগুলো এজন্যই বললাম আমাদের ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলো আর জীবনের কষ্টগুলো প্রতিনিয়তই আমাদের হাসায়-কাঁদায়।
আমি ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনেকটা শখের বসেই এসেছিলাম সংবাদপত্রের জগতে। কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক শিকল পত্রিকা দিয়ে শুরু হয় এই জগতে পদার্পণ। এখন অনেক অনুজ সাংবাদিক ডেকে থাকেন সিনিয়র বলে। অর্থাত, বয়স যে বেড়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। যাইহোক, আজকের লেখার বিষয়টি একেবারেই নিজেকে নিয়ে। দেখতে দেখতে প্রায় তিন দশক পূর্ণ হতে চলেছে আমার সাংবাদিকতা। এটা আমার কাছে ছোট্ট সময় মনে হলেও এই সময়ের মধ্যে পার হয়েছে বেশ কয়েকটি সরকার। পরিবর্তন হয়েছে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। আমরা এনালগ যুগে আমাদের সাংবাদিকতা শুরু করলেও ডিজিটাল যুগ পার করে এখন অবস্থান করছি স্মার্ট যুগে। আসলে এখন কালেরধারায় বদলেছে আমাদের সাংবাদিকতা। এক সময়ের প্রিন্টের পত্রিকার কদর উবে গিয়ে এখন দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মোবাইল সাংবাদিকতা। বাঁশি খবর নয়, স্মার্ট যুগের মানুষের রুচি পাল্টেছে একেবারেই আনকোরা খবরের। তারা ঘটনার সাথে সাথে দেখতে চাচ্ছে ভিডিও এবং স্থিরচিত্র।
অনেকের মনে আছে জাপানের ইয়াসিকা ক্যামেরা আর সনি ব্রান্ডের টেপরেকর্ডারে কথা। ওই সময়ে এইগুলো থাকা মানে সে ছিল স্মার্ট সাংবাদিক। সময়ের কারণে ওগুলো এখন ইতিহাস।
একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন মানেই একজন স্মার্ট সাংবাদিক। তবে, এটাকে নেগেটিভভাবে দেখারও কিছু নেই। এটা যুগের পরিবর্তন। সবকিছু বদলে যাবে, নতুনরা আসবে এই জায়গাগুলো পুরণ করতে। তবে, মোবাইল সাংবাদিকতা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আমি কিছুটা শংকিত। আমার কাছে কেনো যেনে মনে হচ্ছে এর একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়াও তৈরী হচ্ছে পাঠক সমাজে। কারণ, এই সাংবাদিকতা সমাজের ঘটে যাওয়া কিছু তথ্যচিত্র সমাজকে বিভ্রান্তও করছে। অথচ, অকেগুলো বিষয় মাথায় রাখা উচিৎ একজন সাংবাদিককে। একজন সাংবাদিককে খাটি দেশপ্রেমিক হওয়া উচিৎ। দেশের ক্ষতিসাধিত হয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়, সংবাদকে কেন্দ্র করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, গুজব সৃষ্টি হয় এমন মিথ্যা তথ্য পরিবেশনসহ সংবেদনশীল বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরী। প্রকৃত অর্থেই জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করতে হবে সাংবাদিকদের।
৯০‘র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাংবাদিকতার একটা মোহে পড়েছিলাম আমি। মনে হয়েছিলো সমাজের সমস্ত অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম, দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব কলমের শাসনে। এছাড়া এলাকার উন্নয়নে শরিক হওয়ার পাশাপাশি সমাজের নির্যাতীত নীপিড়িত মানুষের পক্ষেও কথা বলা যায়। মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমাজের মানুষেকে মানবিক সেবা দান করা যায়।
৯০ র দশকের সেই শারীরীক সক্ষমতা এখন আর নেই। তবে অধ্যায়টা এখন আমার কাছে সোনালী স্মৃতি। আর এটাই আমার কাছে গর্ব।
আমরা এখন ডিজিটাল দেশে থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে অবস্থান করছি। আর এই স্মার্ট বাংলাদেশে এখন অনেক অনলাইন পোর্টাল, অনলাইন এসব নিউজ পোর্টালের সাথে যুক্ত হয়েছে মাল্টিমিডিয়া। দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা, ইউটিউব চ্যানেল, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সাথে যুক্ত হয়েছে আইপি টিভি। এসব গণমাধ্যমে হাজার হাজার সংবাদকর্মী কাজ করছেন। সংবাদপত্র শিল্পে এখন অনেক মানুষের জীবন জীবিকার সংস্থানও হয়েছে।
কিন্তু সাংবাদিকতার মানদন্ড নীচে নামতে নামতে এখন এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে, তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব নিউজ পোর্টালের বেশিরভাগ সাংবাদিকই অপ্রশিক্ষিত, সঠিক শিক্ষা সনদবিহিন, অপেশাদার ও ভিন্নপেশার লোক। বেশিরভাগ অনলাইন সাংবাদিকতার মান এখন অনেকটাই অরুচীকর, পেশাদারিত্বহীন।
মেইন স্ট্রিমের শতাধিক জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা মূলধারায় অবিচল থাকলেও সারা দেশে হাজার হাজার অনিয়মিত পত্রিকা, নিবন্ধনহীন অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ফেসবুক পেজ ইয়োলো জার্নালিজমকে স্থায়ী রুপ দিতে রিতিরকম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এসব অখ্যাত অনিয়মিত পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল ও ফেসবুক পেজ বন্ধে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিক এবং সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়কে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপ না নিলে গোটা সাংবাদিক সমাজই জাতির কাছে বিরাট এক প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। এক সময় গোটা জাতি তথ্য সন্ত্রাসে আক্রান্ত হবেন।
সাংবাদিকতা পেশা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। এ পেশায় ভোগ বিলাশী জীবন যাপনের কোন সুয়োগ নেই। পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল থেকে যে বেতন ভাতা পাওয়া যায় তা দিয়ে জীবন ধারণ করা অতি কষ্টকর। সম্মানে অতি উচু হলেও বেতন ভাতায় অতি নীচুতা গ্রাস করে আছে এই পেশাটাকে। মুল ধারার হাতে গোনা কিছু জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলে পেশাদার সাংবাদিকদের বেতন ভাতা সুনিশ্চিত থাকলেও অন্যান্য হাজার হাজার পত্রিকা এবং কিছু টিভি চ্যানেলে সেই নিশ্চয়তা একদমই নেই। ফলে অনেক পেশাদার সাংবাদিক জীবন জীবিকার চাহিদা মেটাতেই যুক্ত হচ্ছেন আরেকটি পেশার সাথে।
সাংবাদিকতাটাকে পার্টটাইম জব হিসবে বেচে নিচ্ছেন অনেকে। আসলে পেটে ক্ষুধা থাকলে মাথায় শুভচিন্তা আসে না। পেশার সম্মান বজায় রাখতে হলে সাংবাদিকদের অর্থনেতিক বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। এটা সুনিশ্চিত করতে পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের মালিক পক্ষকেই এই দায় নিতে হবে।
আমরা দেখেছি সব পেশাতেই ঝুঁকি ভাতা রয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা প্রতি নিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রান নাশেরও হুমকি পান। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য দেশে আজোও তৈরী হয়নি “সাংবাদিক সুরক্ষা আইন“। তবে, বর্তমান সরকার এখন বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমরা দেখেছি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময় সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে থাকেন। এজন্য তাদের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে অথচ, সাংবাদিকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বীমা ব্যবস্থা নেই দেশে।
সাংবাদিকতাতে আসার কথা ছিল শিক্ষিত, চৌকস, মেধাদীপ্ত যুব সমাজকে। বিভিন্ন কারনে এসব শিক্ষিত ও মেধাবী সমাজটা এই পেশাটিকে এড়িয়ে চলেন। আর এই সুযোগে মেট্রিক পাশ বা অর্ধ শিক্ষিতরা বিনা বেতনে সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন।
এক্ষেত্রে কিছু অখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ৫ শ বা ১ হাজার টাকার বিনিময়ে সাংবাদিক তৈরী করছে। নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ ও বাজারজাত না করতে পারলেও কার্ড বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা জন্ম দিচ্ছেন অর্ধ শিক্ষিত বা বিনাবেতনের অসংখ্য সাংবাদিক। ফলে সাংবাদিক পেশার মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে।