পৃথিবীর জাতীগোষ্ঠীর ইতিহাস উত্থান পতন অত্যাচার নিপীড়ণ রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সংঘটিত ও বিস্তারিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত জাতি দেশ নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে এবং পৃথিবীর মানচিত্রে নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে সে সমস্ত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অত্যাচার বিপ্লব সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠা ও মুক্তি এসেছে।
পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। অসংখ্য উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম সংঘাত অবশেষে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভাষণ সেই ভাষণ অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছিল। সামনে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে শেষ বাক্যটির পূর্বে যে বাক্যটি বলেছিলেন এবং গভীর অভিব্যক্তি সহকারে প্রকাশ করেছিলেন “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবর রহমানের এই কথার মধ্য দিয়ে এদেশের অসংখ্য আপামর মানুষ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের সংঘতি, স্থিতি, অস্তিত্ব টিকিয়ে এবং বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও অধিকার এদেশের সর্বসাধারণ সর্ব মানুষের। এই ভাষণের পরবর্তী সময়ের ঘোষণা ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা। বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীকে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ শসস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পরাভূত করে। ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ দিনের ব্যবধানে মেহেরপুর মহকুমার নির্জন প্রত্যন্ত গ্রাম বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। এই অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা এবং বিদেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই সরকারের গুরুত্ব সমস্ত দিক বিবেচনায় পৃথিবীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল এবং সমর্থন পেয়েছিল।
যার স্বীকৃতি আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকরের রূপরেখা ছিল নিম্নরূপ :
রাষ্ট্রপতি : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উপ-রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি)
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্ণেল এমএজি ওসমানী
খন্দকার মোশতাক আহমেদ : ক. পররাষ্ট্র বিষয়ক খ. আইন ও সংসদ বিষয়ক
ক্যাপ্টের এম মনসুর আলী : ক. অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব খ. বাণিজ্য ও শিল্প গ. পরিবহন
এএইচএম কামরুজ্জামান : ক. স্বরাষ্ট্র বিষয়ক খ. সরবরাহ, ত্রাণ ও পূনর্বাসন গ. কৃষি
Politics is not a pouch of tobacco, it cannot be handed over, it must be earn G.B. Show এর একথার মূল্যায়ন যথার্থভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। আব্রাহাম লিংকন, আইজেন হাওয়ার, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাস বোস, শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, যাদের জীবন বীক্ষণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।
এদেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম ও কারাবরণ করেছেন। প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে এদেশের মাটি ও মানুষের ভাব ও ভাবনাকে অঙ্কুরিত করেছেন। গভীর মমতায় বুকে ধারণ করেছেন বলেই তিনি বলতে পেরেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” এভাবেই ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণের পরেই যথার্থভাবে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। তাঁর উদ্দাত্ত কণ্ঠের ঘোষণা, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব”। এভাবেই মুজিবনগরের ১৭ এপ্রিল বিশ্বের মানচিত্রে জ্বাজল্যমান হয়ে উঠল। সেই থেকেই মুজিবনগর সারা বাংলাদেশ তথ্য বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করেছিল।
সমগ্র দেশ, সমবেত জনতা, জাতির প্রতিটি মানুষ তার এই ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছিল, প্রাণের কথা মনে করেছিল। মনে করেছিল জীবনের মুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নরপিশাচ ইয়াহিয়া খান ও তার সাগরেদরা বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল এবং ২৫ মার্চ কাল রাত্রি হতেই শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ, এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। আর সঙ্গে সঙ্গে বর্বর বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিডিআর হেড কোয়ার্টার এবং সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে তাদের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর মাধ্যমে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ তাদের ভয়াবহ নৃশংস হত্যার সম্মুখীন হয়। বিভৎস সেই হত্যাযজ্ঞের মহানায়ক ইয়াহিয়া ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েও তিনি ছিলেন অবিচল, জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন-নির্ভীক এক মহানায়ক।
মেহেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রাম হতে জীবন, প্রাণকে বাজি রেখে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিসংগ্রামে সবাই নাম লেখাতে থাকে। তৎকালীন মহকুমার প্রশাসক ছিলেন জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সঙ্গে আরও ছিলেন জনাব মাহবুব উদ্দীন। তখন মেহেরপুরের মাননীয় এমএনএ মরহুম জনাব হুহীউদ্দীন আহমেদ-এর নেতৃত্বে দারিয়াপুরের হাজী ইদ্রিস আলী, গাংনীর জালাল উদ্দীন, ইসমাইল হোসেন, ইসরাইল হোসেন, আব্দুল মান্নান মাষ্টার, শাহবাজ উদ্দীন লিঙ্গু, আতাউল হাকিম (লালমিয়া), খাদেম আলী, আসকার আলী, নৈমুদ্দিন, মেহেদী বিল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য। এঁরা তাঁদের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে প্রাণ দিয়ে ভালবাসা দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে অকৃপণভাবে দেশের জন্য কাজ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন জাগরণে তাঁদের অবদান বাংলাদেশ তথা মেহেরপুরের ইতিহাস চির জাজ্বল্যমান হয়ে থাকে।
সিন্ডিকেট ভেঙে ইতিশীল হবে ভোগ্য
এভাবেই নয় মাসের মুক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ । কিন্তু যথার্থভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রক্তক্ষরণ ও স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি কি? আজকে সূবর্ণ জয়ন্তীর পরবর্তী সময়ে সামাজিক বৈষম্য গুম খুন ধর্ষণ কালোবাজারী যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তাতে এদেশের সকল মুক্তিকামী মানুষ সঙ্কিত বিহ্বল ও মর্মাহত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবর রহমানের স্বপ্নকে বাস্তাবয়ন করতে হলে ১৭ এপ্রিলের শপথকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবেই নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেথক সাহিত্যিক ও গবেষক