১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের জীবনের ঝূঁকি নিয়ে ১২ জন আনসার সদস্য গার্ড অব অনার প্রদান করেছিলেন। তাদের মধ্যে সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে জিবিত রয়েছেন তিন জন আনসার সদস্য।
পুলিশ-ইপিআরের কেউ ভয়াবহ পরিণতি চিন্তা করে গার্ড অব অনার দিতে রাজি না হলেও জীবনের মায়া ত্যাগ করে শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন ১২ জন আনসার সদস্য।
আনছার সদস্য আজিম উদ্দীন স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, সেদিন মা মাটি আর মানুষের মুক্তির কথা ভেবে স্বাধীনতার অকুতভয় সূর্য্য সৈনিক ১২ জন আনসার জীবনের মায়া ত্যাগ করে মন্ত্রী পরিষদকে গার্ড অব অনার প্রদানে রাজি হয়েছিলেন।
তৎকালীন মেহেরপুরের পুলিশ অফিসার মাহবুবুর রহমানের (এসপি মাহবুব) নেতৃত্বে পিসি ইয়াদ আলী, আনসার সদস্য আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজুল ইসলাম, অস্থির মল্লিক, হামিদুল ইসলাম, সাহেব আলী, লিয়াকত আলী, নজরুল ইসলাম, ফকির মোহাম্মদ, মহিউদ্দিন, কেসমত আলী ও মফিজ উদ্দিন অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
আজিম উদ্দীন আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুজিবনগরের ভবরপাড়ার ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে কুষ্টিয়া চলে যান। সে সময় ঐ ক্যাম্পের রক্ষণাবেক্ষণের দয়িত্ব পান স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য।
ভারত থেকে যে সব খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্র-গোলাবারুদ, জ্বালানী তেল এদেশে আসতো সেগুলো সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা একত্র করে মেহেরপুরের তৎকালিন এসডিও তৌফিক এলাহীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা) হাতে তুলে দিতেন আনছার সদস্যরা। পরে এ সব সামগ্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করা হতো।
১৬ এপ্রিল সকালে তৌফিক এলাহি ১২ আনসার সদস্যকে ডেকে বলেন, বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে কিছু মেহমান আসবেন। আপনার আয়োজন সম্পন্ন করেন। সেমত গ্রামবাসীদের সহায়তায় বর্তমান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের স্থানে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে কয়েকটি চৌকি এনে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। ঐদিন রাতেই ভারতীয় ফোর্স এসে সেখানে অবস্থান নেয়।
পরদিন সকালে ভারতের সীমানা পেরিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় আসেন জাতীয় চার নেতা। সাথে আসেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। সেখানে জাতীয় চার নেতা শপথ নেন এবং ১২ আনসার সদস্যের সাথে গার্ড অব অনার নেন। এরপর গার্ড পরিদর্শন করে আবারও চলে যান।
জীবনের মায়া ত্যাগ করে আর বুক ভরা আশা নিয়ে গার্ড অব অনার ও দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝপিড়ে পড়েছিলেন তারা। এদের মধ্যে ৮ জন নিরাশায় প্রস্থান করেছেন পরপারে।
পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে রক্তিম সূর্য্য ছিনিয়ে আনার আমরণ লড়াইয়ে যারা রণাঙ্গণে পিছপা না হওয়া সেই অকুতভয় নির্ভিক সৈনিকদের আক্ষেপ রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে।
অকুতভয় সূর্য্য সৈনিক মফিজ উদ্দিনের স্ত্রী সকিনা বেগম জানান, সংসারে এতই অভাব ছিল যে, টাকার অভাবে নিজের বাড়ীর জমির খাজনা না দিতে পারায় জমি খাস হয়ে যায়। ২ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে তিনি ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন। বর্তমানে বড় ছেলের ভ্যান চালানো আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চলে।
সেদিনকার ঘটনার জন্য সে ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা পুরুস্কার হিসাবে রুপার একটি মেডেল পেয়েছিলেন। স্ত্রী সকিনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, যে মানুষটি সংসার ছেলে-মেয়ের কথা চিন্তা না করে জীবনের বাজী রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছিল। অথচ সেই যুদ্ধের পর টাকার অভাবে ঠিক মত সংসার চলাতে পারনি।
এ জন্যই কি যুদ্ধ করেছিল? সরকারী অনুদান তেমন একটা পায়নি। তার মৃত্যুর পর পরিবারের লোকজন একটি দু’রুম বিশিষ্ট ঘর বুঝে পেয়েছেন।
গার্ড অব অনার প্রদানকারী জীবিত ৩ আনসার সদস্য হামিদুল হক, আজিমুদ্দীন শেখ ও সিরাজুল ইসলাম বলেন ‘তখন করেছি স্বাধীনতাযুদ্ধ আর এখন জীবনযুদ্ধ। দিনমজুরের কাজ করি। শরীরে তেমন শক্তি নাই।
তারপরও অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করতে হয়। দিনমজুরি করে এখনও সংসার চালাতে হয়। জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চালাতেই হবে। তবে আশার কথা হলো তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বকৃতি পেয়েছেন। এতে প্রতি মাসে ভাতা পাচ্ছেন। তাই দিয়েই কোনমতে চলছে সংসার।
অবিস্মরণীয় সাহসিকতার সঙ্গে তারা বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রীয় পদক তারা পেতেই পারেন। সরকার অনেককেই তো পদক-খেতাব দিচ্ছে। জাতির এই বীর সন্তানদের সম্মান দেওয়া উচিত।
জীবিত তিন জন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম ১২ জন আনসার। অথচ মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্য বা মুর্যালে দেখানো হয়েছে আটজনকে। ছবি থাকা সত্ত্বে সেখানে সকলের অবয়বও সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি।
মুজিবনগর সরকারই দেশের প্রথম সরকার। এটি অস্থায়ী বা প্রবাসী সরকার নয়। এর সরকারের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ঐদিন শপথ গ্রহণ না হলে বাংলাদেশের মু্িক্তযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন বলে বিশ্বেরবুকে দাড় করাতো পাকিস্তান।