মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলায় রশিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি চালু করার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসমান গনির হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন মোনাখালী ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য জহির উদ্দীন খান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন মোনাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান। ইউপি সদস্য জহির উদ্দীন খান বলেন, রশিকপুর গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। শিশুদের শিক্ষা নিতে যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার দুরে পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে।
এজন্য ২০০৩ সালে সেকেন্ডারি এ্যাডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় এক কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মান করা একটি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো। কিন্তু স্থানীয় কিছু অসাধু রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী লোক ও কয়েকজন প্রধান শিক্ষকের কু চক্রে বিদ্যালয়টি চালু হয়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়টি খোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৬ বছর পার হলেও বাস্তবায়ন করেনি কেও। এটা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করা হলেও আমলে নেইনি সরকার।
উল্লেখ্য, মামলা জটিলতার কারনে ১৬ বছরেও শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে চুরি হয়েছে বিদ্যালয়টির আসবাবপত্র, বৈদুতিক ফ্যান, সুইজ, জানালার গ্রিল। ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে কাচেঁর জানালা। রাতের বেলায় মাদকসেবিদের আড্ডা বসে।
বিদ্যালয়টির জমি নিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একটি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সুত্র জানিয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, পাঠদান শুরু করার যাবতীয় উপকরণ ওই ভবনে ছিল। বিদ্যালয়ের সামনে বড় একটি খেলার মাঠ রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছিল। কিন্তু আইনি জটিলতায় বিদ্যালয়টি উদ্বোধন করা যায়নি। গ্রামে এটি ছাড়া আর কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। গ্রামের ৩৫০জন শিক্ষার্থীকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। অথচ হাতের কাছেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু সেটি চালানো হচ্ছে না। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় জানায়, শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া গ্রাম মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার রশিকপুর।
২০০৩ সালে সেকেন্ডারি এ্যাডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় এক কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয় বিদ্যালয়ের অবকাঠামো। ২০০৩ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া দেশের ৫৪ টি উপজেলায় এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪ টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার মধ্যে ৫৩ টি বিদ্যালয় এমপিওভূক্ত হয়েছে। সরেজমিনে গত বুধবার রশিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে দির্ঘ ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটি পড়ে থেকে ভুতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
দুতলা বিশিষ্ট ভবনের প্রতিটি জানালার কাচঁ চুরি হয়েছে। গ্রিল ভেঙ্গে ভেতর থেকে চেয়ার বেঞ্চ টেবিল ওধাও হয়েছে। সিলিং ফ্যানর ও বৈদুতিক সুইজ গায়েব। এমনকি দেয়ালে সুইজ লাগানো প্লাস্টিকের বোর্ড গুলোও চুরি হয়ে গেছে। বাথরুমের পানির ট্যপ হারিয়েছে। দেয়াল বেয়ে ওঠেছে সেওলা। ২০১৬ সালের মার্চে রশিকপুর গ্রামের শিক্ষার্থীরা বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভৈরব নদে নৌকাডুবে সপ্তম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ববিতা আক্তার ও তানিয়া খাতুন মারা যায়। তানিয়া খাতুনের পিতা হাবিবুর রহমান বলেন, “গ্রামের ( রশিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়) বিদ্যালয়টি চালু না হওয়ার কারণে সব শিক্ষার্থীদের ৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতে হয়। আমার মেয়েও বিদ্যালয়ে পড়তো। একদিন পরিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল ভৈরব নদে গ্রামের ৩০জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তলিয়ে যায় তাদের নৌকা।
আমার মেয়ে তানিয়া ও ববিতা ডুবে মারা যায়। গ্রামের বিদ্যালয়টি থাকলে হয়তো এভাবে মারা যেতো না মেয়েটি”। রশিকপুর গ্রামের বাসিন্দা জাহিদ শেখ বলেন, বিদ্যালয়টি চালু না হওয়ায় মুল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের আগের মত কষ্ট করে দুরের বিদ্যালয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন এলাকায় টিন দিয়ে নির্মাণ করা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে পড়াশোনা করে। সামান্য একটা সমস্যার কারণ দেখিয়ে ১৬ বছর ধরে বিদ্যালয়টি চালু করা হয়নি।
প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া বিদ্যালয় চালু করা সম্ভব না। রশিকপুর গ্রামের বাসিন্দা দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী মিম খাতুন বলেন, গ্রামের বিদ্যালয় থাকা সত্তেও পাচঁ কিলো পথ পাড়ি দিয়ে বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতে হয়। যাতায়ত করার জন্য গ্রামে শুধুমাত্র ব্যাটারি চালিত ভ্যান চলাচল করে। অনেক সময় সময়মত ভ্যন পাওয়া যায়না। গ্রামের অনেকে দুরের বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ঝামেলার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় তাদের মেয়েদের।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরে মাধ্যমিকে পড়ানোর তাগিদ ও কম হয়ে যায় শুধুমাত্র দুরের বিদ্যালয়ে যেতে হবে ভেবে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা আমান উদ্দিন বলেন, রশিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি নতুন এসে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য আমি পাইনি। বিদ্যালয়টির জমির মালিক আম্মাতন নেছা বলেন, আমার তিন বিঘা আম বাগানের গাছ কেটে বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়।
তৎকালিন বিদ্যালয় ম্যনিজিং কমিটি সঙ্গে কথা ছিল ওই জমির বদলে মাঠে আবাদ করা যায় এমন পাচ বিঘা জমি কিনে দেবে তারা। পরে আর বিদ্যালয় নির্মাণ করার পরে কথা না রাখার কারণে আমি ২০০৪ আদালতে মামলা করি। তৎকালিন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য জাহান আলী বলেন, যখন বিদ্যালয়টি নিমাণ হয় ওই সময় বিএনপির স্থানীয় নেতারা বলেছিলেন এলাকার রশিকপুর গ্রামের শিক্ষিত বেকার ছেলেদের বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হবে।
আম্মাতন নেছার জমির বদলে পাচ বিঘা কৃষি জনি দেওয়া হবে। এসব দাবির কোনটায় পুরুন সম্ভব না হওয়ার কারণে সে আদালতে মামলা করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসমান গনি বলেন, আমি আজকে বিদ্যালয়টি চালু করণ সংক্রান্ত স্মারকলিপি পেয়েছি। বিদ্যালয়টি চালু করার জন্য এর আগেও আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটি পরে আর চালু করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়টি চালু করা প্রয়োজন। আমি জেলা প্রশাসকের আলোচনা সাপেক্ষে জটিলতা নিরসন করে বিদ্যালয়টি চালু করা হবে।