সাগর পাড়ি দিতে ইচ্ছুক, কঠোর পরিশ্রমে আগ্রহী, সাহসী, বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করতে চান এমন ব্যক্তিদের জন্য মেরিন পেশাটি বেশ পছন্দের পেশা। এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এই পেশায় বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যায়। সেই সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার, আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায়। বাংলাদেশি মেরিনাররা প্রতি বছর দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য ক্যাডেট ভর্তি করা হয় এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এটি চট্টগ্রামের জলদিয়াতে অবস্থিত। মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে এটি ছিল একমাত্র নৌ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর মেরিন একাডেমী পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। প্রারম্ভিকভাবে ৪০ জন ক্যাডেট নিয়ে (২০ জন নটিক্যাল ও ২০ জন ইঞ্জিনিয়ারিং) এর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে প্রতিবছর ২০০এর অধিক ক্যাডেট মেরিন একাডেমী চট্টগ্রামে ভর্তি হয় এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ক্যাডেট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী চট্টগ্রাম ওয়াল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, সুইডেন এর অধীনে নিবন্ধিত।
এছাড়াও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রামে মেরিন ফিশারিজ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। মেরিন ফিশারিজ একাডেমি সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, নিয়ন্ত্রণ এবং নৌ বাণিজ্যিক সেক্টরের জন্য পেশা ভিত্তিক মেরিটাইম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মেরিন পেশাকে আরো বিকশিত করার লক্ষ্যে পাবনা, রংপুর, সিলেট ও বরিশালে নতুন চারটি মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে ও এগুলির ক্যাডেট প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
এছাড়াও আরো তিনটি প্রাইভেট মেরিন একাডেমি চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর প্রায় ৫০০ জন মেরিন ক্যাডেট সরকারি এবং প্রাইভেট একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রামে ফিমেল ক্যাডেট ভর্তি শুরু হয়। বর্তমানে ফিমেল ক্যাডেটরাও দেশি এবং বিদেশি জাহাজে কর্মরত আছে।
মেরিন একাডেমিতে দুইটি ডিসিপ্লিন এর ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় ১। নটিক্যাল বা ডেক ডিপার্টমেন্ট ২। ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট।
একাডেমিতে প্রি সি প্রশিক্ষণ শেষ করে তারা বাণিজ্যিক জাহাজে ডেক বা ইঞ্জিন ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করে। ডেক ডিপার্টমেন্ট থেকে সি টাইম কমপ্লিট করে এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্রমান্বয়ে থার্ড অফিসার, সেকেন্ড অফিসার, চিফ অফিসার এবং সর্বশেষ ক্যাপ্টেন হওয়া যায়। একইভাবে ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে ফোর্থইঞ্জিনিয়ার, থার্ডইঞ্জিনিয়ার,সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার ও সর্বশেষ চিফ ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। পদোন্নতির জন্য প্রতিটি পরীক্ষাতেই পাস করতে হয়।
বাংলাদেশী মেরিনাররা সাধারণত প্রফেশনাল পরীক্ষা গুলো বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর,ইউকে,অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় দিয়ে থাকে।
সমুদ্রগামী জাহাজ ছাড়াও মেরিনাররা দেশি -বিদেশি নৌ বন্দর,জাহাজ ব্যবস্থাপনা,মেরিন সার্ভে প্রতিষ্ঠান,দেশি-বিদেশি পাওয়ার প্লান্ট, শিল্প কারখানায় কাজের সুযোগ পান। পোর্ট ক্যাপ্টেন এবং মেরিন সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবেও অনেকে দেশে এবং বিদেশে চাকরিতে আছেন। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও অনেক মেরিনার দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ পণ্য পরিবাহিত হয় শিপিং বা বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে। বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শিপিং সেক্টর। সমুদ্রপথে কম খরচে আন্তর্জাতিকভাবে মালামাল, খাদ্যদ্রব্য, কাঁচামাল এবং তৈরি পণ্য পরিবহন করা সম্ভব। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ শিপিং এর তথ্য মতে ৫০০০০ এর অধিক জাহাজ আন্তর্জাতিকভাবে চলাচল করছে এবং ১৯ লক্ষ সি ম্যান এই পেশায় কর্মরত আছে । তার মধ্যে প্রায় ৮.৫ লক্ষ অফিসার এবং ১০.৫ লক্ষ রেটিংস।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯০ টি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে বি এস সি বা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের রয়েছে আটটি জাহাজ। বাকিগুলো বিভিন্ন শিপিং কোম্পানির জাহাজ। করোনা দেশের জাহাজ শিল্পে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
গত তিন বছরে দেশের সমুদ্রগামী বহরে চল্লিশটির বেশি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। আইনি সুরক্ষা, কর সুবিধা ও ক্রমবর্ধমান ফ্রেইট চার্জের কারণে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশে বিদেশে জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মেরিনারদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মেরিন সেক্টরকে আরো এগিয়ে নিতে হলে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের আরো বেশি জাহাজ ক্রয় করা প্রয়োজন, তাতে আরো বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সাথে মেরিনারদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে বিদেশি কোম্পানিতে চাকরিরত মেরিনাররা আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠাতে পারবে।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন বা আই এম ও করোনা কালে মেরিনারদের আন্তর্জাতিকভাবে কি ওয়ার্কার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে কারণ তারা করোনার মধ্যেও বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে । তরুণরা মেরিন পেশায় অনেক বেশি আগ্রহী হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে দেশে -বিদেশে মেরিনারদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।