মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুরে আবারও অভিযান চালিয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও মুজিবনগর থানা পুলিশ। এসময় অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সাদ্দাম হোসেন (৩০) নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। আটক সাদ্দাম হোসেন আব্দুর রশিদ সর্দারের ছেলে।
মঙ্গলবার রাত ১১ টার দিকে ডিবির ওসি সাইফুল ইসলাম ও মুজিবনগর থানার ওসি মেহেদী রাসেলের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম যৌথ অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় সাদ্দামের ব্যবহৃত চারটি এনড্রয়েড মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে পুলিশ তাকে আটক করার আগেই টের পেয়ে সে পালাতে না পারলেও জুয়ার সাইট ব্যবহার করা অ্যাপগুলো আগে থেকে আনস্টল করে দেয়।
বুধবার দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার কাছে থেকে একটি জুয়ার এজেন্ট নাম্বার উদ্ধার করা হয়েছে। পরে বিকালে তাকে মুজিবগরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হয়। এসময় সাদ্দাম হোসেনের ৭দিনের পুলিশি রিমাণ্ড আবেদন করা হয়েছে। পরবর্তি শুনানির দিন রিমাণ্ডের আবেদন শুনানি হবে।
মেহেরপুর ডিবির ওসি সাইফুল আলম বলেন, আটক সাদ্দাম হোসেনের ৭ দিনের পুলিশি রিমাণ্ড চেয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
এনিয়ে পুলিশ গত এক মাসে জুয়ার সাথে জড়িত ৬ জনকে আটক করলো। তারা হলেন বদরুদ্দোজা রয়েল, নিমাই হালদার, প্রসেনজিৎ হালদার, সুমন আলী, মোস্তাফিজুর রহমান সুমন এবং সাদ্দাম হোসেন।
আর পড়ুন: মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা
তবে পুলিশের এজাহার ভুক্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা অনলাইন জুয়ার মামলার ১৫ আসামি এখনো অধরা রয়েছেন। গত ২৫ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের দেড় মাস হতে চললেও ওই ১৫ জনের কেউ এখনো আটক হয়নি। ফলে অনলাইন জুয়া কার্যক্রম তারা বিভিন্ন স্থান থেকে চালিয়ে যাচ্ছে।
মামলার এজাহারে জানা গেছে, ২৪ আগস্ট বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলকে আটক করার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত নাম স্বীকার করে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাব, গোপালপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিশির বিশ্বাস, বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দিপু, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম, একই গ্রামের আনারুল মিয়ার ছেলে রুবেল, টঙ্গীর শরিফের ছেলে পলাশ, মুজিবনগরের শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয়, একই গ্রামের জিনারুলের ছেলে লিপু গাজী, মোনাখালী গ্রামের আজহারুলের ছেলে মিলন, সাইদুর রহমান খোকনের ছেলে সাগর, কোমরপুর গ্রামের বাশার বিশ্বাসের ছেলে সজীব, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ মণ্ডলের ছেলে বাবু, মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বখতিয়ার মাস্টারের ছেলে রুবেল, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের মৃত কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার।
মাস্টার মাইণ্ড খ্যাত বেশ কয়েকজন এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছেন। যাদের নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনে গত দুই পর্বে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সম্প্রতি আটক সাদ্দাম হোসেন মেহেরপুর প্রতিদিনের প্রকাশিত অনলাইন জুয়ার হোতাদের একজন প্রশিক্ষিত মাস্টার এজেন্ট বলে মেহেরপুর প্রতিদিনের কাছে তথ্য রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাশিয়ায় পাচার করছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর এই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত মেহেরপুরের সরকার দলীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মুজিবনগরের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, কয়েকজন শীর্ষ ছাত্র নেতা, স্কুল ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেনীর প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত মাসোহারা নেন অনলাইন জুয়াড় সাথে জড়িত এজেন্টদের সাথে। তাদের মাসোহারা দিয়ে দেদারছে জুয়া খেলে কোটি বনে যাচ্ছেন এসব এজেন্টরা। আর পথে বসছেন হাজার হাজার তরুণসহ জুয়া খেলার জড়িত ব্যক্তিরা।
আরও পড়ুন: মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল একের পর এক অনলাইন জুঁয়ার দূর্গে হানা দেওয়া শুরু করেছেন। এদিকে ডিবির অভিযানে ওই দুই জুয়াড়ি গ্রেফতারের পর বাকিরা এলাকা থেকে গাঁ ঢাকা দিয়েছে বলে জানান ডিবি পুলিশের একটি সুত্র।
গোয়েন্দা সংসস্থার মতে, মেহেরপুর জেলাতে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছেনা অনলাইন জুয়ার। রাতারাতিই কোটিপতি বনে যাচ্ছেন অনেকে। জুয়াড়িরা বিভিন্ন অ্যাপস ও সাইট ব্যবহার করে অনলাইনে বিভিন্ন গেমিং বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে জুয়ায় মেতে উঠেছে।
বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেনসি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে দুই বছরে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে জানান সংস্থ্যাগুলো।
রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত জুয়াড়িদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন। অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তারা কাজ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলা পরিচালনার জন্য (ওয়ানএক্সবিট, মেল বেট, লাইন বেটসহ বেশ কয়েকটি সাইটের মাধ্যমে এ জুয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
আরও পুড়ুন: অনলাইন জুয়ার হোতা নুরুল ও জামানকে শোকজ
সুত্রটি জানান, মেহেরপুর জেলার অনলাইন জুয়ার এই চক্রটির মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যেটি অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে বিদেশে।
এছাড়া মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত সম্পদের পরিমান। আগামীতে অনলাইন জুয়ার মাস্টার মাইণ্ড হিসেবে যারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সম্পদের বিস্তারিত নিয়ে প্রকাশ করা হবে। (চলবে…)