ক্যাপাসিটির অধিক গ্রাহক বাড়িয়ে বেশি আয় করার লোভে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে চলেছেন মেহেরপুরে স্থানীয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা। প্রতারণা করে গ্রাহকদের কাছে থেকে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এতে একদিকে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে অফিস, স্কুল-কলেজ ক্লাস, সংবাদ সংগ্রহ ও অনলাইন কেনাকাটা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) এর কাছে বারবার অভিযোগ করলে তারা অভিযোগ গায়ে মাখেন না। এমনকি গ্রাহকদের সাথে খারাপ আচরণ করতেও ছাড়েন না।
কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৪৫ ধারা বলা আছে গ্রাহকদের সাথে কোন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তি প্রতারণা করলে একবছর কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
জানা গেছে, করোনায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও সীমিত পরিসরে বাইরে যাওয়া কারণে দৈনন্দিন অনেক কাজই অনলাইনে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সংবাদ সংগ্রহ অফিশিয়াল মিটিং ইন্টারনেট সম্পন্ন হচ্ছে। এমনকি স্কুল-কলেজে ভার্চুয়াল ক্লাস ও কেনাকাটার মতো দৈনন্দিন কাজও ইন্টারনেট নির্ভর। তবে জেলা শহরে ইন্টারনেটের গতির অবস্থা করুণ হওয়ায় সব কাজে-কর্মেই ভীষণ ব্যাঘাত হচ্ছে। বিষয়টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের বলেও সমাধান হচ্ছে না। তারা অধিকাংশ সময়ই ‘আপনার যন্ত্র/ডিভাইস/সিস্টেম পুনঃচালনা করুন।’ এতে কখনো কখনো সাময়িক পরিত্রাণ মিললেও প্রকৃতপক্ষে ফলপ্রসূ কিছু হচ্ছে না। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনা দুর্যোগে ইন্টারনেটের গ্রাহক ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় আইএসপি সেই তুলনায় ব্যান্ডইউথ সরবরাহ করছে না। কারণ তারা তাদের সক্ষমতার অনেক বেশি ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে। ফলে একই ইন্টারনেট গতি নির্ধারিত গ্রাহকের তুলনায় অনেক বেশি গ্রাহকদের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ায় গতি ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
শহরে ঘুরে দেখা গেছে, গ্রাহকরা বিটিসিএল, ম্যাঙ্গো টেলিকম, সামিট কমিউনিকেশন, বাংলাফোন, ভার্গো কামিউনিকেশন, নভোকম আইসিসি, জিওটেল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কম দামে সাব-লাইন কিনে ব্যবসা করছেন । মেহেরপুরে কমিম্পউটার মেট ,কার্নিভালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই সকল ফাঁদ ফেলে গ্রাহকদের সাথে প্রতরাণা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এই সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাইক্রোটিক রাউটার ২৪ ঘন্টা চালু রাখার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে ইউজাররা ইন্টারনেট সুবিধা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন।
বাড়িবাকা সীমান্ত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ^াশত নিপ্পন। তিনি থাকেন মেহেরপুর জেলা শহরে। তিনি জানান, স্থানীয় কম্পিউটার মেট থেকে মাসিক ৮০০ টাকায় সংযোগ নিয়েছেন। এজন্য তাকে ৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেওয়া কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ব্যান্ড উইথ চুরি করছে বলেই ইন্টারনেটে গতি পাচ্ছেন তিনি। ৩০০ মিটারের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ থাকার কথা। কিন্তু ১০ মিটারের বাইরে গেলে সংযোগ থাকে না। তিনি ভোক্তা অধিকার আইনে প্রশাসনের কাছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দাবি জানান।
মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকায় কর্মরত আইটি ইনচার্জ রোকনুজ্জামান জানান, আমরা অফিসে কার্নিভাল থেকে ২০ এমবিপিএস এর লাইন নিয়েছি। কিন্তু কোন সময়ই ৫এমবিপিএস এর বেশি পাই না। অভিযোগ দিলে তাৎক্ষণিক বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আবার যা ছিল তাই হয়। এর আগে কম্পিউটার মেটের লাইন ছিল। তাদেরও একই অবস্থা ছিল। অতি লাভ করার আশায় ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের সাথে এ ধরণের প্রতারণা করেই চলেছেন। এর একটা ব্যবস্থা হওয়ার দরকার।
মেহেরপুর সরকারি বালক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘কম্পিউটার মেট’ থেকে সংযোগ নিই। ইন্টারনেট গতি না থাকার সংযোগ বাতিল করেছি। ইন্টারনেটে গতি না পাবার কারণে অভিযোগ করলে কম্পিউটার মেট থেকে বলা হয়, কম্পিউটারটি অফ করে অন করুন। তাদের কথা মতো অফ করে অন করলেই গতি বেড়ে যায় সর্বচ্চ ১ ঘন্টার মতো। পরবর্তীতে গতি না পেলে অফ অন করলে গতি বাড়ে না। বিষয়টি রহস্যজনক। এই কারণেই এখন অতিরিক্ত টাকা খরচ করে মডেম ব্যবহার করি।
এ বিষয় নেট ব্যবসায় জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় কন্ট্রোল রুমে ম্যানেজেবল সুইজ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যখন অভিযোগ করা হয় তখন কম্পিউটার অফ করে অন করতে বলা হয়। এই সময় এক ঘণ্টার জন্য চাহিদার এমবিপিএস দেওয়া হয়। কম্পিউটারে কমান্ড দেওয়া থাকে সর্বচ্চ ১ ঘন্টার জন্য। এই সময় এমবিপিএস (গতি) ঠিক থাকে। একঘণ্টা পর অটো এমবিপিএস কমে যাবে। যা ইউজারদের প্রতারণা করা হচ্ছে।
কম্পিউটার মেটের মালিক জুয়েল প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে রুঢ় ভাষায় জানান, আমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। তথ্য লাগলে আমার অফিসে আসেন।
কার্নিভালের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ইমতিয়াজ হক জানান, গ্রাহকদের অভিযোগের কারণে আমরা কোম্পানী পরিবর্তন করেছি। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে গ্রাহকরা ভাল মানের সার্ভিস পাবেন। গ্রাহকরা ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে এর জন্য কোন ক্ষতিপূরণ বা অর্থ ফেরৎ দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, না দেওয়া হয়নি।
সাবেক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ওয়ালিদ হাসান লিটন জানান, মাদার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে দামে ব্যান্ডউইথ কিনে সেই দামেই বিক্রি করতে হয়। ফলে কোন লাভ থাকে না। লাভবান হতে হলে ১০০ ইউজারের জন্য কেনা ব্যন্ডউইথ ২০০ জনের মধ্যে বিক্রি করতে হবে। তাতে ইউজাররা চাহিদার গতি থেকে বঞ্চিত হয়। এই কারণে তিনি ইন্টারনেট ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সজল আহমেদ জানান, এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান বলেন, ইন্টারনেটের গতি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও সমস্যা পড়তে হচ্ছে। অভিযোগ পেলে বিটিসিএল এর কর্মকর্তাদের নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।