যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবিতে ২০৬টি সংগঠনের পক্ষে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।
আজ রবিবার দুপুরে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক শামীম হাসানের হাতে স্বারকলিপি তুলে দেন জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের মেহেরপুর জেলা শাখার সভাপতি শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম।
এসময় জাতীয় কন্য শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নার্গিস সুলতানা, সদস্য আজিজুল হক রানু, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ এর গাংনী এরিয়া অফিসের সমন্বয়ক হেলাল উদ্দীন।
স্বারকলিপিতে বলা হয়, আপনার (প্রধানমন্ত্রী) বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আপনার আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতা নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ পদসমূহে নারীর সক্রিয় উপস্থিতিতে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের কাছে অনুসরণীয়।
আমরা জানি, বিগত তিন দশকে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১’, ‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন২০১০’, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ (সংশোধিত)’, ‘হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন-২০১২’, তৃতীয় লিঙ্গের আইনি স্বীকৃতি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭’-সহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। এরপরও, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও নারী ও শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পরিবারে, সামাজিক পরিসরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যানবাহনে কোথাও এদেশের নারী ও শিশুরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার একটি বড় অংশ হচ্ছে- যৌন হয়রানি ও নির্যাতন। রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, জনসমাগমস্থল, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও এই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি সহপাঠীদের দ্বারা যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একইসাথে বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসা, কলেজ, গণপরিবহন, রেলস্টেশনে যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যেগুলো বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, যৌন হয়রানি বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে এধরনের সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে।
অনলাইনেও হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ- পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডাবি−উ) তথ্য অনুসারে, বিগত ১৫ মাসে অনলাইনে ভুয়া আইডি (পরিচয়) খোলা, আইডি হ্যাক, প্রতারণা, মুঠোফোনে হয়রানি ও আপত্তিকর আধেয় বা কনটেন্ট ছড়ানোর সাড়ে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। এ বাস্তবতা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, যৌন হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের জন্য অনতিবিলম্বে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তাঁরা সুরক্ষা ও প্রতিকার পেতে পারেন। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম ৭০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং ২৮টি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে।
সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন মোট ৩৮৫ জন, যার মধ্যে ১১১ জন নারী এবং ২৭৪ জন কন্যাশিশু। অন্যদিকে গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য বলছে, বিগত ২৩ বছরে এই সেন্টার থেকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় ৬২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। মামলা হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৪৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ এর ক্ষেত্রে রায় হয়েছে এবং সাজা কার্যকর হয়েছে ১ শতাংশের কম।
ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারের কাছে যৌন সহিংসতার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন না থাকায় ভুক্তভোগীরা মানসিক, শারীরিক, আর্থিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা মনে করি সহিংসতা ও যৌন হয়রানির এই ভয়াবহ বাস্তবতার পেছনে যথাযথ বিচার না হওয়া এবং বিচার না পাওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আমরা আরও মনে করি, যৌন হয়রানির ঘটনার বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে একটি বড় অস্তরায়। এই সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট আইন, যা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রদত্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের নিমিত্ত আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক বিষয়টিও সুনিশ্চিত করবে।
এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম, বর্ণ, বয়স, পেশা ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য সম-সুযোগ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবার বিধানটিকেও নিশ্চিত করবে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা সর্বত্রচিত্তে আপনার কাছে প্রত্যাশা করি, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আপনি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আইন ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন‘ অতিসত্ত্বর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০২৪ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সু¯পষ্ট অঙ্গীকার ‘কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’র যে প্রতিশ্রুতি, সেটা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আমাদের জোরালো দাবি আপনার নেতৃত্বেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন অতিসত্বর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হবে, যার মাধ্যমে নারী ও শিশুদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত হবে এবং সর্বস্তরে সংঘটিত যৌন সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।