জীবন বিকাশের অত্যাবশ্যক সহায়ক হচ্ছে শিক্ষা, শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া কোন মানুষই সভ্য হতে পারে না। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা গ্রহণ তো বলাই বাহল্য। নানান সংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের। তাদের মধ্যে অন্যতম দলিত বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা। প্রান্তিক শিশুদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কিভাবে তাদের আগামীতে সুরক্ষিত রাখা যায়- সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দলিত জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষা কতটা সুরক্ষিত ? এটি একটি বড় প্রশ্ন অনেকের কাছে।
দলিত শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করণের সমস্যা ও উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা হয় বিভিন্ন জনের সাথে। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক টানাপোড়ন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করা, মর্যাদাহীন পেশায় লিপ্ত থেকে মানসিকভাবে হিনমন্যতায় ভোগা, সংঘবদ্ধভাবে শিশুদের সামনে বিভিন্ন ধরণের নেশাদ্রব্য ব্যবহার করা, ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেয়া, অভিভাবকদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে না পারা, নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং সমাজে দলিত জনগোষ্ঠীকে আলাদা চোখে দেখা- শিশুদের শিক্ষা বা বিদ্যালয়মুখী না হওয়ার অন্যতম কারণ। শিশুদের শিক্ষা সুরক্ষায় উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে । তা নাহলে প্রান্তিক এই শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে ।
মেহেরপুর সুইপার কলোনীতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ১৫ বছর বয়সী অপূর্ব বাঁশফোড় শহরের ড্রেণ পরিস্কারের কাজ করছে । ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৬ বছর বয়সী আদরী বাঁশফোড়, ২য় শ্রেণী পর্যন্ত ১৫ বছর বয়সী জ্যোতি বাঁশফোড় ও রেখা বাঁশফোড় লেখাপড়ার ইতি টেনে বাড়িতেই থাকে।
৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ১৮ বছর বয়সী রাজন বাঁশফোড় , ২য় শ্রেণী পর্যন্ত ১৫ বছর বয়সী রাকেশ বাঁশফোড়, ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত ১৯ বছর বয়সী শুভ বাঁশফোড়, ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত ২০ বছর বয়সী কৃষ্ণা বাঁশফোড়, ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত ১৭ বছর বয়সী বিকি বাঁশফোড়, ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত ১৭ বছর বয়সী গোপী বাঁশফোড় ও ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ১৯ বছর বয়সী দ্বিপক বাঁশফোড়, এরা সকলেই শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝাড়ুদারের কাজ করছে ।
৭ম শ্রেণী পর্যন্ত ১৫ বছর বয়সী বৈশাখী বাঁশফোড় ও ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত ১২ বছর বয়সী শ্যামলী বাঁশফোড় সেলাই মেশিনে কাজ করে সংসারের হাল ধরেছে। ১৭ বছর বয়সী সূর্য বাঁশফোড় ও ১৪ বছর বয়সী বিকাশ বাঁশফোড় কোনদিনই স্কুলে যায়নি।
৭ বছর বয়সী দেবা বাঁশফোড়, সুস্মিতা বাঁশফোড় , সোহানি বাঁশফোড়, ৯ বছর বয়সী সূবর্ণা বাঁশফোড় এখনও স্কুলে যায়না। সুইপার কলোনীর মোট বাসিন্দার ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়না।
নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার থেকে বেরোতে পারছেনা মেহেরপুরের দলিত জনগোষ্ঠিরা। নিজেদের রীতিনীতি ও বংশপরম্পরাই চলে আসা কর্মক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের জীবন। ফলে লেখাপড়ার দিক থেকে মুকুলেই ঝরে যাচ্ছে ৯০ ভাগ শিশু। শতকরা মাত্র দুইজন পেরোতে পারছে মাধ্যমিক লেভেল। অধিকাংশই ঝরে যাচ্ছে মাধ্যমিকে পৌঁছানোর আগে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অবস্থাটা আরও করুণ। সাক্ষর জ্ঞান হলেই মনে করে তাদের লেখাপড়া আর দরকার নেই। এছাড়াও ১২-১৪ বছর বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে।
মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম এর শিক্ষিকা সুমনা হালদার জানান, প্রাক-প্রাথমিকে আমরা খুব কষ্ট করে মন্দির ভিত্তিক শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসি। তবে ভর্তির পরও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্কুলমুখী করা সম্ভব হয়না। নিজেদের পরিবার থেকেও তেমন একটা সাপোর্ট করে না বাচ্চাদের। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলমুখী করলেও শতভাগ উপস্থিতি কোন দিনই হয় না। এভাবে কোন রকম প্রাক-প্রাথমিক শেষ করলেও প্রাথমিকে পৌঁছাই প্রতি ৩০ জনে ১৫ জন। এই ১৫ জনের মধ্যে মাধমিক পর্যন্ত থাকে ১-২ জন। কারণ হিসেবে এই শিক্ষিকা জানান, নিজেদের রীতিনীতি কৃষ্টি-কালচার থেকে বের হতে পারেনা তারা। বাইরের সমাজ ব্যবস্থা বা বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট তাদের কাছে আলাদা মনে হয়। দলিতদের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত যাতে করে কোন সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে চাকরি করতে পারে।
সুইপার কলোনীর অজয় বাঁশফোড় ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ সেমিস্টারের ছাত্র, অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সে তার শিক্ষা জীবনকে চালিয়ে নিচ্ছে। তার মতে- দলিত শিশুরা বিদ্যালয়মুখী না হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে তার মধ্যেঃ – শিক্ষার প্রতি অনিহা, অভিভাবকদের অনিচ্ছা, উন্মুক্ত স্থানে দলবদ্ধভাবে নেশা করা, যেকোন অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, নিজস্ব সমাজ ছাড়া অন্য সাধারণ সমাজের মানুষের সাথে খোলা মেলা মিশতে না দেওয়া, প্রতিবছর কমপক্ষে ১৮-২০ টি নানান ধরণের অনুষ্ঠানে অর্থ ব্যয় করা সহ অহেতুক কিছু বিধি নিষেধ আরোপের কারণে শিশুরা স্কুলমুখী হয় না। এছাড়া নিজেরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলতে হয় যা একধরণের মানসিক হিনমন্যতা তৈরী করে। তাঁর মতে, নিজেদের অনুশাসনগুলো পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের আইন ছাড়া অন্য কোন আইনে চলার জন্য বাধ্য করা যাবে না।
গাংনীর দলিত হরিজন উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি অশোক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন- ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অধিকাংশ পিতা মাতা নিরক্ষর। অন্নের ব্যবস্থা হলেই তারা খুশি। গন্ডিবদ্ধ চিন্তা ধারা, শিক্ষা ছাড়া যে উন্নত জীবন পাওয়া সম্ভব নয় সেই বোধ তাদের মধ্যে নেই। কিছু ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাইলেও অশিক্ষিত গোত্র প্রধানরা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে চাই। বাল্য বিবাহ একটি বড় কারণ। এদের অনেকেই মদ গাজা ভাং নেশাগ্রস্ত। যা আয় করে তা নেশা করেই শেষ করে ফেলে। অনুপ্রেরণা দানের লোকের অভাব। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অপ্রতুল। উচ্চ বর্ণ ও গোত্রের লোকজনের অবহেলা ও ঘৃণা।
এ ব্যাপারে মেহেরপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আপিল উদ্দিন জানান, একিভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন বৈষম্য নেই। সেক্ষেত্রে দলিত শ্রেণীর শিশুরাও প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হতে পারবে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তাদের বিদ্যালয়মূখী করতে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের এ বিষয়ে তদারকি দরকার।
মেপ্র/ইএম