সারাদেশে তালাকের হার বাড়ছে। এই হারটা রীতিমতো ভয়াবহ। দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরে প্রতি সাড়ে ৪ ঘন্টায় ১টি তালাক হচ্ছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই জেলাতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ৫ টি করে।
মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে জেলাতে মোট ২১ শত বিবাহের পাশাপাশি ১৯২৯ টি তালাক রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এই চিত্রটিই উদ্বেগের।
একাধিক নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমানে তালাকের কারণ হিসাবে যৌতুক ও শারিরীক নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় শুণ্যের কোঠায়। বিগত ২/৩ বছরে তালাকনামায় যে কারনগুলি প্রদর্শিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকের অতিরিক্ত আসক্তি। স্ত্রীর পিতা-মাতার স্বামীর পরিবারে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের প্রবণতা। সঠিকভাবে স্ত্রীর ভরণ পোষণ করতে না পারা, যৌন অক্ষমতা এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়েয় পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া।
মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় প্রদত্ত তথ্য মতে সদর উপজেলায় ৭ জন, মুজিবনগর উপজেলায় ৪ জন এবং গাংনী উপজেলাতে ১১ জন সরকার নিবন্ধিত নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের (কাজী) মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেহেরপুর সদর উপজেলায় ৮০২ টি বিবাহের বিপরীতে ৯৭৪ টি তালাক, মুজিবনগর উপজেলায় ৫৫২ টি বিবাহের বিপরীতে ২৩৩ টি তালাক এবং গাংনী উপজেলায় ৭৪৬ টি বিবাহের বিপরীতে ৭২২ টি তালাক নিবন্ধিত হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ ও এর পরিপেক্ষিতে পরবর্তীতে সংঘটিত তালাকগুলি আইনগত ভাবে লিপিবদ্ধ হয়না। বিষয়গুলি আদালতে গড়ায়। ফলে এই পরিসংখ্যান সঠিক ভাবে উঠে আসে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ শীর্ষক জরিপের তথ্য অনুযায়ী মেহেরপুর জেলায় ২২ সালে মোট জনসংখ্যা ৭ লাখ ৫ হাজার ৩৫৬ জন। প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে জেলায় বিবাহের হার ২২ এবং তালাকের হার ২.৭। সে অনুযায়ী ২০২২ সালে মেহেরপুর জেলায় মোট বিবাহের সংখ্যা ১৫ হাজার ৫ শত ১৫ টি এবং তালাকের সংখ্যা ১৯০৪ টি।
তবে বিবিএস জরিপের তথ্যে তালাকের পরিসংখ্যান জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের সাথে কিছুটা কসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও মোট বিবাহের বিবাহের তথ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
এবিষয়ে মেহেরপুর জেলা পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ বসির উদ্দিন বলেন, জনশুমারীর ক্ষেত্রে প্রত্যেকের দোরগোড়ায় যাওয়া হয়। সেখানে ভূলের সম্ভাবনা নেই। তবে বিবাহ-তালাকের পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে একটি স্যাম্পল এরিয়া নির্ধারণ করে ফলাফল বের করা হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত সংখ্যার সাথে জরিপের ফলাফলে সংখ্যাগত কিছু ব্যাত্বয় ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল সমাজ মনে করে, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল তৈরি হলে বা বনিবনা না হলে, চট করে একটি বাচ্চা নেওয়া উচিৎ। তাহলে সম্পর্ক টিকে যাবে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তখন সন্তান এই নাটকের অংশ হয়ে যায়, তার জীবন হয়ে যায় বিভীষিকাময়। কারণ, শিশু যদি দেখে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, ভুল বোঝাবুঝি, মারামারি বা শীতল সম্পর্ক চলছে, তা সন্তানের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মেহেরপুর পৌর এলাকার একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার খায়রুল ইসলাম(বাশার)। তিনি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৮ টি বিবাহ ও ১০০ টি তালাক রেজিস্ট্রি করেছেন। আর ২৩-২৪ অর্থ বছরে এখন পর্যন্ত ৩৩ টি বিবাহ ও ৮৫ টি তালাক রেজিস্ট্রি করেছেন।
খাইরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ জেলাতে তালাকের হার পল্লী অঞ্চলে শহরের তুলনায় প্রায় ৮২ শতাংশ বেশি, এটিই উল্লেখযোগ্য তথ্য। শহরের ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের দম্পতিরা বিভিন্ন কারণে যে বিষাক্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও গ্রামের মানুষ সেটা করছেন না। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান তালাকের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে সংসারের বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়ে বাবা-মা মেয়ের সংসারে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করতে চান। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক বিষাক্ত হয়ে উঠছে। যার শেষ পরিণতি বিচ্ছেদে গড়াচ্ছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার হলো বর্তমানে তালাকের কারণ হিসেবে যৌতুক ও শারিরীক নির্যাতনের অভিযোগ তেমন দেখা যাচ্ছে না।’
মেহেরপুর সদর উপজেলার নিকাহ রেজিস্ট্রার আব্দুল মাবুদ জানান ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার কাছে ১৪৫ টি বিবাহ ও ২৪৫ টি তালাক রেজিস্ট্রি হয়েছে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত তার মাধ্যমে ১১৩ টি বিবাহ ও ২১৬ টি তালাক রেজিস্ট্রি হয়েছে।
আব্দুল মাবুদ আরও বলেন, ‘বাল্য বিবাহের কারনে তালাক বেশি হচ্ছে। এছাড়াও এ অঞ্চলে তালাকের একটি বড় কারণ হলো স্বামী বিদেশে থাকা। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় প্রবাস থেকে স্বামীর পাঠানো টাকার হিসাব না রাখা, যত্রতত্র খরচ করা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীর অবর্তমানে পরকীয়া জড়িয়ে পড়া। ‘
মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট সেলিম রেজা কল্লোল বলেন, ‘ যে সকল বিবাহ বিচ্ছেদ আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে সেগুলোর কারণ অনুসন্ধান করলে স্পষ্ট হয় যে সমাজে নৈতিকতার পতন ঘটেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। নারী-পুরুষ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে, স্ত্রী স্বামীকে মানতে বা তার অধিনে থাকতে চাইছেন না। মূলত এসকল কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। বর্তমানে নারীরা অতিরিক্ত স্বাধীনতাকামী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা স্বাবলম্বী হতে চায়, এবং স্বাবলম্বী হতে যেয়ে অনেকেই অনৈতিক পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে আবার প্রবাসে থাকা স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বামীর পাঠানো টাকা তসরুপাত সহ পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ‘
অপর এক আইনজীবী এডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, ‘মূল কথা হলো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস হারিয়ে গেলে তা একটি অস্বাস্থ্যকর ও লোক দেখানো সম্পর্কে পরিণত হয়। তখন সন্তান, দায়-দায়িত্ব সব কিছুই ঠুনকো হয়ে পড়ে। সম্পর্কটা হয়ে যায় সাংঘর্ষিক। নানা রকম আলাপ-আলোচনা করেও যখন সমন্বয় করা যায় না, তখন বিয়ে বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।’