মেহেরপুরের আঞ্চলিক মহাসড়ক ও সড়ক গুলো এখন শ্যালো ইঞ্জিন চালিত অবৈধ যানবাহনের দখলে। দিনের পর দিন মৃত্যু’র মিছিল দীর্ঘ হলেও ট্রাফিক পুলিশ দূর্ঘটনা রোধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জেলায়। গত দু বছর আগে ট্রাফিক পুলিশের তাড়া খেয়ে মটরসাইকেল নিয়ে পালাতে গিয়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে গাংনীর ভোমরদহ গ্রামের সাবেক এক সেনা সদস্য’র মৃত্যু হয়। পরে জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে যায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
এলাকাবাসির অভিযোগ মেহেরপুর সড়ক মহাসড়ক অবৈধ যান দাপিয়ে বেড়ালেও অজ্ঞাত কারনে ট্রাফিক বিভাগ নিরবতা পালন করে আসছে। অবৈধ যান চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও নেই নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে এসব অবৈধ যান।
গতকাল বুধবার দিবাগত সন্ধ্যায় গাংনীর পোড়াপাড়া নামক স্থানে ট্রাকের ধাক্কায় রাণী খাতুন (২৫) নামের এক গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। সে মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের নাহিদুজ্জামানের স্ত্রী। রাণী খাতুন তার শ্বশুরের মোটরসাইকেল চড়ে গাংনী উপজেলা শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় একটি ট্রাক মোটরসাইকেলকে ধাক্কায় দিলে ছিটকে মাটিতে পড়ে নিহত হয় সে।
গাংনীর বাওট বাজারে অদূরে গত শনিবার দুপুর সাড়ে ১২ টায় মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের বাওট বাজার সংলগ্ন এলাকায় ট্রাক ও হোপার (ধানমাড়াই গাড়ী) মুখোমুখি সংঘর্ষে আক্তারুল ইসলাম (৩৫) নামের এক চালক নিহত হয়েছে। নিহত আক্তারুল ইসলাম গাংনী উপজেলার হিজলবাড়িয়া গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে ও হোপার (ধানমাড়াইগাড়ী) চালক। এ ঘটনার পরপরই লাশের পাশ দিয়ে মেহেরপুরের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা গেলেও উদ্ধার কিংবা ঘাতক ট্রাক আটক না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয়রা। এ নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় অভিযুক্ত ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য’র বিরুদ্ধে বিভীগীয় মামলা ও কৈফিয়ত তলবের নির্দেশ দেন মেহেরপুরের পুলিশ সুপার এসএম মুরাদ আলী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মাইক্রোবাস চালক জানান, কাগজ পত্র ঠিক থাকলেও ট্রাফিক পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিয়ে তাদের চলতে হয়।
আলগামন চালকরা জানান,ট্রাফিক পুলিশ তাদের আটক করলেও নজরানা দিলেই ছেড়ে দেয়।
কয়েকজন ইটভাটা মালিক জানান, ইটভাটা চলাকালিন সময়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের টাকা নিয়েই লাটাহাম্বার চালানো হয়। টাকা না দিলে গাড়ি ধরে নিয়ে থানায় আটক রাখার হুমকী দেন।
চলতি মাসের ৮ তারিখ (মঙ্গলবার) জেলায় পাখি ভ্যান ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। এদের মধ্যে চার জনকে রেফার্ড করা হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে।
গত মাসের ২৪ তারিখে মেহেরপুরের বিসিক এলাকায় পাখি ভ্যানের ধাক্কায় সাংবাদিক ইয়াদুল মোমিন মারাতœক জখম হন। দুই সপ্তাহ ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে নিজ বাড়িতে বিছানাগত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এছাড়াও গত ২৮ আগস্ট সদর উপজেলার ইসলামনগর-খোকসা গ্রামের মাঠে স্যালো ইঞ্জিন চালিত অবৈধ যান আলমসাধুর ধাক্কায় খেজমত আলী (৫২) নামের এক কৃষক নিহত হন। এর আগে ৯ জুলাই মোমিনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মীর মাহবুব (৫৮) বিদ্যালয় থেকে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় গরু বোঝাই ট্রলির ধাক্কায় নিহত হন। গতকাল গাংনীতে রানী খাতুন নামের এক গৃহবধু ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু বরণ করেন।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে প্রায় প্রতিদিনিই গড়ে ১০-১৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এদের মধ্যে কয়েক জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় অন্যত্র রেফার্ড করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছে। এই দুর্ঘটনার অধিকাংশই অবৈধ পরিবহনের কারনে ঘটেছে।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এহসানুল কবির আল আজিজ মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিন ১০-১৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে তিন চাকার অবৈধ পরিবহনের কারণে। বর্ষা মৌসুমে এই দুর্ঘটনার পরিমান অন্য সময়ের তুলনায় বেশি।
মেহেরপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে মাঝে মধ্যে চেকপোষ্ট বসিয়ে এইসব অবৈধ গাড়ি আটক করা হলেও থামছে না এদের চলাচল। গত তিন দিনে মেহেরপুর পুলিশের অভিযানে মাত্র ৩৪টি অবৈধ পরিবহন আটক করা হয়। তারপরও মেহেরপুরের প্রধান সড়কে চোখ রাখলেই দেখা যাবে এদের আধিপত্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেহেরপুরে প্রায় ৭ হাজার ইজিবাইক ও ৩ হাজার শ্যালো ইঞ্জিন চালিত অবৈধ যান বাহন চলাচল করে। যানজট থেকে শুরু করে দুর্ঘটনার প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এইসব পরিবহনকেই। লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করলেও শুধূ মাত্র খরচের অযুহাত দেখিয়ে পণ্য সরবরাহের কাজে এ সকল অবৈধ যান গুলো বেশি ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি ইট ভাটার মালিকরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা পরিচালনা করলেও তারাও এ সকল অবৈধ যানবাহনের মাধ্যমে ইট সরবরাহ করে থাকেন। ফলে সর্বত্রই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ সকল অবৈধ যান বাহন চালালেও প্রশাসনিকভাবে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে চোখে পড়ে না। এভাবে চলতে থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলবে।
মেহেরপুর জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, অবৈধ নসিমন, করিমনের কারণে আমাদের বড় গাড়ি চালাতে সমস্যা হয়। অবৈধ গাড়িগুলো রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। তাদের এই বেপরোয়ার কারনে অনেক সময় আমাদের দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। এসব অবৈধ যান বাহন ব্যবহার করা হচ্ছে মেহেরপুরের বিভিন্ন পন্যের পরিবেশকের কাজে। বড় প্রতিষ্ঠানের পণ্য বহন করাই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেউই।
এ বিষয়ে মেহেরপুর পুলিশ সুপার এসএম মুরাদ আলী বলেন, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত এইসব অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রন করতে হলে নিজেদের সচেতন হতে হবে। এই সব গাড়ি গুলো যেখানে তৈরি হয় আগে সেই কারখানা বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও অবৈধ যানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে এবং বেশ কিছু গাড়ি আমরা ইতিমধ্যে আটক করেছি।
আলামিন হোসেন ও মর্তুজা ফারুক রুপক