কেউ ভালোবেসে, কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। শুরু হয় একটি
সুখী সংসারের ’পরশ পাথরের’ গল্প। ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা
করেছিনু আশা। প্রথমদিকে দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়াটা হয়ে ওঠে
’সোনার হাতে সোনার কাকন অলংকারে’র মতো বাঁধানো।
কিন্তু বুকভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা
দিচ্ছে না সুখপাখি। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে
যাচ্ছে অনেকের সংসার। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংসারের বন্ধন দুর্বল
হচ্ছে ক্রমেই। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ভালো লাগা, ভালোবাসাও
যাচ্ছে কমে। ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ।
গত এক দশকে বদলে গেছে তালাকের ধরন। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের
ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। কিন্তু ’সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’
প্রচলিত এই প্রবাদ সময়ের ব্যবধানে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখন তালাকের
ঘটনায় নারীরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ৮০
শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটছে স্ত্রী কর্তৃক। অতীতকালে সংসার ছিল
বর্জ কঠিন বাঁধনে বাঁধা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন ঠুনকো
কাচের দেয়ালে পরিণত হয়েছে সেই বন্ধন। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই
প্রায় অভিন্ন চিত্র। স্বপ্নগুলো সত্য হয়ে উঠতে না উঠতেই খানখান
হয়ে যাচ্ছে।
মেহেরপুর প্রতিদিন এর অনুসন্ধানে ও জেলা রেজিষ্ট্রারের তথ্য অনুযায়ী
গত এক বছরে মেহেরপুরে বেড়েছে তালাকের সংখ্যা। এর মধ্যে স্ত্রী
কতৃক স্বামী তালাকের সংখ্যাই বেশি। জেলা রেজিষ্ট্রার হতে প্রাপ্ত তথ্য
অনুযায়ি ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেহেরপুরে
তালাক রেজিষ্ট্রি হয়েছে ১ হাজার ৪শ ৭৪টি। এর মধ্যে স্ত্রী কতৃক
তালাকের সংখ্যা ৬১৮টি, স্বামী কতৃক তালাকের সংখ্যা ৫৩৬টি এবং
উভয়ের সম্মতিতে তালাকের সংখ্যা ৩২০টি। এছাড়াও চলতি বছরে
করোনাকালিন সময়ে ঘটেছে বেশ কিছু তালাকের ঘটনা যার বেশির
ভাগই স্ত্রী কতৃক।
ঝামেলা এড়াতে অনেকেই পার্শ্ববর্তী জেলা বা অন্য জায়গাতে
ঘরোয়াভাবে শেরে ফেলে বিবাহ বিচ্ছেদের কাজ। কখনো কখনো গ্রাম্য
সালিসের মাধ্যমেও হয়ে থাকে বিচ্ছেদ। যা রেজিষ্ট্রারে জমা পড়েনা। এর
সংখ্যাও কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা মেহেরপুরে এধরনের সামাজিক পরিবর্তনের বেশ কিছু কারণ
চিহ্নিত করেছেন। মেহেরপুর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু বলেন, বিবাহ নিবন্ধক, মনোবিজ্ঞানী
এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন হ্রাস, বহুগামিতা,
বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, অতিমাত্রায় ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ,
অর্থনৈতিকভাবে নারীদের শক্ত অবস্থান, পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-
সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, শারীরিক ও
মানসিক নির্যাতনের কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ এবং আলাদা থাকার
প্রবণতা বাড়ছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় একজন নারী এখন
তার পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা করতে পারছে। পারিবারিক বন্ধনের
চেয়ে অনেক নারী নিজের পেশা জীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর
মনস্তাত্ত্ব্ধিসঢ়;বক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ফলে নারী নিজেই
এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
মেহেরপুর পৌরসভার ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কাজী তাজুল
ইসলাম বলেন, চলতি বছরে এ পর্যন্ত বিবাহ রেজিষ্ট্রি হয়েছে ৪২ টি।
তালাক হয়েছে ১০৮টি। ছেলে কতৃর্ক তালাক হয়েছে ৪৯টি, উভয়ের
সম্মতিতে তালাক হয়েছে ৪৬টি এবং মেয়ে কতৃক তালাক হয়েছে
১৩টি। তবে কাজীর মতে মেয়ে কতৃক তালাকের সংখ্যা এক্ষেত্রে কম হলেও
অধিকাংশ সময় ছেলে কতৃক তালাক দিতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে।
আরও কয়েক জন কাজীর সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা জানান, তালাকের
সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’।
স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর
সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা,
মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত,
নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত
অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না
হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামী।