মেহেরপুরে আলোচিত আটলান্টিক হোটেল কাণ্ড মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ও এলাকার বিতর্কিত নারী নিলুফার ইয়াছমিন রুপার পক্ষে মানববন্ধন করলেন আওয়ামী লীগের ভূঁইফোঁড় সংগঠন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের ব্যানারে কয়েকজন।
আর এই ভূঁইফোঁড় সংগঠনের জেলা কমিটির আহবায়ক (প্রস্তাবিত) নিলুফার ইয়াছমীন রুপার প্রকাশিত একটি পোষ্টারকে ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের মন্তব্যে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে প্রতিবাদের ঝড়। নিলুফার ইয়াছমীন রুপার ছাপানো পোষ্টারে দেখা যাচ্ছে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছোট করে রুপার ছবির নিচে দেওয়া। পোস্টারের এই ছবি নিয়ে ইতিমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আব্দুল মান্নান তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেই পোস্টকে কেন্দ্র করে এখন শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। নেতাকর্মীরা বিতর্কিত নারী নিলুফার ইয়াছমীনকে গ্রেফতারেরও দাবী জানিয়েছেন।
জানা গেছে, মেহেরপুর শহরের সব চাইতে আলোচিত হোটেল আটলান্টিক কান্ড মামলায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত মাসের ১১ তারিখে নিলুফার ইয়াছমীন রুপাকে ১৩ নম্বর আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন। এই চার্জশিটের প্রতিবাদে নিলুফার ইয়াছমীন রুপা বঙ্গবন্ধু সৈনিকলীগের ব্যানারে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে অল্প কিছু লোক থাকলেও উপস্থিত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু সৈনিকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচয় দানকারী দুই নেতা। এরা হলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা) আমিনুল হক রতন মোল্লা ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম) সেলিম রেজা। তবে স্থানীয় কোনো নেতা কর্মী এই মানববন্ধনে অংশ নেননি।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আব্দুল মান্নান তার নিজ ফেসবুকে রুপার পোষ্টার নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা হুবুহু তুলে ধরে হলো :
মাননীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জেলা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সমর্থক অথবা কর্মী হওয়ার অধিকার অনেকেই রাখে তবে কোন সংগঠন এর ব্যানার ব্যবহারে জেলা আওয়ামী লীগের জানা থাকার কথা। সৈনিক লীগ নামে কোন সংগঠন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ বা জেলা আওয়ামীলীগের কোন সহযোগী সংগঠন কি না, হয়ে থাকলে এটা মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কোন নেতার মদদে চলে, দয়া করে জানালে খুশী হবো।
জেলা প্রশাসক, মহোদয়,এখন তো হাজারো সৈনিকের দখলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের একটা আইন আছে। আমি একটা পোস্টার পোস্ট করছি দয়া করে দেখুন এই পোস্টারটিতে জাতির পিতার ছবি ব্যবহার সঠিকভাবে হয়েছে কিনা।
এদিকে এই পোস্টকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানা মন্তব্য, পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেখান থেকে কিছু মন্তব্য প্রদান করা হলো ।
সুবাদ মিয়া লিখেছেন, এটা ঠিক না, আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি আমাদের মানতে হবে বঙ্গবন্ধু মানেই কিন্তু আওয়ামী লীগ বুঝায়। তাই এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। উনি কে? হঠাত করে সৈনিক লীগ নিয়ে এলো। কোন দিন কোন জাতীয় প্রোগ্রামে দেখি নাই ইনাকে। আর আজ সৈনিক লীগ নিয়ে এলো। আসলে মেহেরপুর জেলায় একে প্রতিহত করতে হবে। এটা আমাদের দাবি।
অ্যাডভোকেট রাকিবুল ইসলাম লিখেছেন, ভুইফোড় সংগঠন এবং এ সকল ব্যক্তিকে দলে জায়গা আমরা সমর্থকরা দিই না,যারা দায়িত্বশীল তাদের দায়িত্ব দলীয় পরিচয় দিয়ে কারা সুবিধা নিচ্ছে সেসব দেখা এবং কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো এরা আমাদের কেউ না।
নাহিদ মাহমুদ লিখেছেন, হেতে কি তাইলে পাওয়ারফুল নাকি, বিচার চাই বিচার চাই,এই মহিলা জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ছবিকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। এই মহিলার বিরুদ্ধে অবিলম্বে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানাচ্ছি। এই মহিলা এত বড় খারাপ অপকর্মটি করার দুঃসাহস দেখায় কি করে।
তাসনিম তামান্না লিখেছেন, এই মহিলা খুবই উচ্ছৃংখল, উনার বাসা রাবেয়া ক্লিনিকের পেছনে। এসব মহিলার ডাইরেক্ট এ্যাকশন নিতে হবে।
রাইহান উদ্দীন মন্টু লিখেছেন ডিম থেরাপি দেওয়া হোক, সকল হোতা বের হয়ে আসবে।
রানা নাইম একাধিক পোষ্ট দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি পোস্ট তুলে ধরা হলো, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি জনাব হারুনুর রশিদ জানিয়েছেন তিনি রুপা নামে মেহেরপুরের কাউকে চেনেন না এবং এই নামে কোন প্রস্তাবিত কমিটি তার দপ্তরে জমা পড়েনি। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিকে এই নোংরামির বিষয়ে জানানো হয়েছে। অতি দ্রুত এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সঠিক তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমি একজন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে বলতে চাই আগামী ২৪ ঘণ্টার ভিতরে স্বাধীনতার সূতিকাগার মুজিবনগর অধ্যুষিত মেহেরপুর জেলার যেসব স্থানে এই পোস্টার লাগানো হয়েছে তা যদি অপসারিত না হয় এবং এই মহিলা যদি জনসমক্ষে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চায় তাহলে আমরা আওয়ামী প্রেমী জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মীরা কঠোর আন্দোলন ঘোষণা করবো। যার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যেন ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস না পাই।
ইতিপূর্বেও সে নিজেকে একবার বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের আহ্বায়ক দাবি করেছিল মেহেরপুর জেলা শাখার। গতকাল আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করার সময় নিজেকে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ মেহেরপুর জেলা শাখার প্রস্তাবিত আহ্বায়ক ঘোষণা করেছে। কে তাকে প্রস্তাব করেছে আমরা জানতে চাই। এর আগে একটি স্কুলে গার্লস গাইডদের দিয়ে গার্ড অফ অনার নিয়েছে কোন ক্ষমতার বলে। তখন প্রতিবাদ করা হয়নি বলেই আজকে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এই ধরনের ধৃষ্টতার সাহস দেখিয়েছে। একে কোন ধরনের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই যারা একে সমর্থন করবে আমি মনে করি তারা আর যাই হোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে পারে না।
জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু,জয়তু জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
কে এই রুপা ?
রুপা মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের সবজীর আড়ৎ ব্যবসায়ী মিঠুর স্ত্রী। আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগে রুপা গাংনী ডিগ্রী কলেজপাড়াতে তার স্বামীসহ দুটি ছোট কক্ষ নিয়ে ভাড়া নিয়ে থাকতেন। রুপার স্বামী মিঠু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির স্থানীয় নেতা। সে কাঁচা মালের আড়ৎ ব্যবসা করে কোনো মতে সংসার চালাতেন। রুপা তখন থেকেই উচ্ছৃংখল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। পরে বিএনপি ক্ষমতা হারালে মেহেরপুর শহরে পালিয়ে আসেন স্বামীসহ। তারপর থেকে মেহেরপুর শহরের টপ লেবেলের রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের এক ধরণের লোকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।
নিলুফার ইয়াছমীন রুপা এই শহরের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে স্বামী মিঠুর পরিচয় না থাকলেও রুপার সাথে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। তারপর থেকে আর রুপাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সম্পদের উপর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। মেহেরপুর শহরে আলীশান বাড়ি, তার দুই মেয়েকে বিশাল অংকের টাকা খরচ করে লেখাপড়া শেখানো, নিজে প্রাইভেটে চলাচল সব মিলিয়ে তার আলীশান জীবন যাপন। এর মধ্যে রুপার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে গাংনী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী প্যাডির সাথে। প্যাডি এলাকায় বেশ কয়েকটি খুন করে রুপাকে নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে থাকে। সে সময় প্যাডি তার নিকট আত্মীয় প্রথম আলো ও বণিক বার্তা পত্রিকার একজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে। বেশ কয়েকদিন পর ওই সাংবাদিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেসময় প্যাডি পালিয়ে যায়। পরে সাংবাদিক হত্যা মামলায় প্যাডির ফাঁসির আদেশ হয়। প্যাডি পালিয়ে গেলেও রুপা বহাল তবিয়তে মেহেরপুর ফিরে এসে ধর্নাঢ্য জীবন যাপন শুরু করে।
এলাকাবাসি জানান, রুপার গ্রামের বাড়ি গাংনী উপজেলার হাড়িয়াদহ গ্রামে। তার পরিবারের লোকজন সবাই জামায়াত এবং স্বামীর পরিবার বিএনপি হলেও রুপা হঠাৎ করেই তার গায়ে আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে নেন। রুপা মাঝে মধ্যে একজন উদ্যোক্তা, কখনো সাংবাদিক, কখনো শিক্ষিকা, কখনো ব্যবসায়ী আবার কখনো শিল্পী পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এদিকে রুপার বিষয়ে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ খালেক বলেন, রুপা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের পরিচয়া দেয় কিনা আমার জানা নেই। জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের ব্যানারে কোনো কিছু করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।