শিশুরা সুন্দর। শিশুরা নিষ্পাপ। প্রতিটি শিশুই ফুলের মতো ফুটবার এবং সুন্দররূপে বিকশিত হবার দাবি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু সম্পদের অসম বণ্টন ও সামাজিক অসংগতির শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। সেই সাথে করোনার থাবা। যাদের কচি হাত হয়ে ওঠেছে শ্রমের হাতিয়ার। করোনাকালিন সময়ে দির্ঘদিন স্কুল বন্ধ এবং অঘোষিত লকডাউনের ফলে নি¤œ শ্রেনীর মানুষের আয়ের উৎসও কমে গিয়েছে।
ফলে পারিবারিক চাহিদা ও অভাব অনটন মেটাতে বিভিন্ন কর্মে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা। কম টাকায় শ্রম পাওয়া যায় সেজন্য অনেকেই তাদেরকে কাজে লাগাই।
মেহেরপুর মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ি জেলায় শিশু শ্রমের হার ৭ শতাংশ। এদের বেশির ভাগই নি¤œবিত্ত পরিবারের। ওয়েল্ডিং, কারখানা, ব্রিক ফিল্ড, মালিক সমিতি, হোটেল ব্যবসায়ী, রাজ মিস্ত্রি, কাঠ মিস্ত্রি এ ছাড়াও মুদি দোকান, সেলুনের দোকান, মাছের ব্যবসা ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে এই সমস্ত শিশুরা। মেহেরপুর জেলায় এ ধরণের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ৬শ ৮৫ জন।
এছাড়াও করোনাকলিন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নি¤œবিত্ত পরিবারের শিশুদের মাঝে এক প্রকার হতাসা তৈরি হয়েছে। ফলে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে তারাও নেমে পড়ছে অর্থ উপার্জনের পথে। এ ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও দেওয়া হচ্ছে উৎসাহ। বর্তমানে অটো, নসিমন, করিমন, বাস, ট্রাক ও মটর গ্যারেজে এই ধরণের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। আবার অনেক ক্ষেত্রে লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার শিকার একজন মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে।
রাধাকান্তপুর গ্রামের মহাসিন আলী ছেলে রাহিদ, ইসলাম ভ্যান চালকের ছেলে সুমন, রাজাপুরের শহিদুল ইসলামের ছেলে সবুজ কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। রাহিদ মটর গ্যারেজে, সুমন কাঠ মিস্ত্রি, সবুজ ওয়েল্ডিং এর দোকানে। বয়সের দিক থেকে ১৪ পেরোইনি কেউই। তাদের ভাষ্য অনুযায়ি স্কুল বন্ধ তাই একটু হাতের কাজ শিখে রাখছি। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এদরে মধ্যে রাহিদের পিতা মহাসিন আলী জানান, বর্তমানে আমাদেও মত গরিব মানুষের ছেলেদের লেখা পড়া করিয়ে কোন লাভ নেই। অর্থাভাবে মাঝ পথেই বন্ধ হয়ে যাবে তাদের লেখা পড়া। আবার চাকরি নিতেও ঘুষ লাগবে। এজন্য ছোট থাকতেই হাতের কাজ শিখলে ভবিষ্যতে সেটা কাজে লাগিয়ে নিজেই উপার্জন করতে পারবে।
বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশু শ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয়। ১২ জুন বিশ্ব শিশু শ্রম শ্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। শিশু অধিকার সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম প্রতিরোধের লক্ষ্যে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ২০০২ সালে বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য এই দিবসটি ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক শিশু শ্রমবিরোধী দিবস। কিন্তু তারপরও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশু শ্রমের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক তৎপরতাও তেমন একটা দেখা যায় না।
মেহেরপুর সদর উপজেলা ঝাউবাড়িয়া গ্রামের খাইরুল ইসলামের ছেলে শিশু শ্রমিক পাপ্পু (১৩) জানান, কয়েক মাস আগে আমার আব্বুর প্যারালাইসিস হয়। সংসারে অভাবের কারণে আমার পড়ালেখার চালাতে পারেনা। তাই আমি দোকানে কাজ করে আমার পরিবারকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করি।
মেহেরপুর বড় বাজারের বীণা স্টোরের মালিক শহিদুল ইসলাম এ ব্যাপারে জানান, পরিবারে অর্থ যোগানকারী ব্যাক্তির অভাব থাকায় অনেক শিশুকে বেছে নিতে হয় এই ধরনের পদক্ষেপ। আবার ইচ্ছাকৃত ভাবে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয় অনেকেই আসে কাজের জন্য। বাংলাদেশে শিশুশ্রম দন্ডনীয় অপরাধ তারপরও তাদের পরিবারের কথা ভেবে মানবিক কারনে তাদের কাজে নিতে হয়।
আরো একজন শিশু শ্রমিক রাশেদ(১৩) জানান, আমার আব্বু আবুল কালাম আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও আমি ওয়েল্ডিয়ের কাজ করি কারণ আমি পড়াাশোনায় খুব একটা ভালো ছিলাম না। স্কুলের পড়া মাথায় ধরে রাখতে পারতাম না। তাই তৃতীয় শ্রেণি থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এই শুরু কাজ করি। প্রায় পাঁচ বছর এই কাজের সাথে জড়িত থাকায় আমি একজন দক্ষ কারিগর হয়েছি।
এ বিষয়ে মানব উন্নয়ন কেন্দ্র(মউক) এর নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান সেলিম বলেন, বর্তমানে মেহেরপুরেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে শিশু শ্রমের হার ৭ শতাংশ। মানব উন্নয়ন কেন্দ্র(মউক) এর উদ্যোগে ইতিমধ্যে বেশ কিছু শিশুকে পুর্নবাসন করেছি। সেই সাথে যে সমস্ত শিশুরা এখনো শ্রমের সাথে জড়িত তাদেরও পুর্নবাসনের ব্যাপরে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করেছি।
মেহেরপুর শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা গোলাম সিদ্দিক বলেন, শিশু শ্রমের বিষয়ে করোনার আগে আমরা একবার মিটিং করেছিলাম। আমি শিশু শ্রম নিরসন কমিটির সদস্য হিসেবে আছি। এটা মূলত কুষ্টিয়া আঞ্চলিক অফিস থেকে দেখাশোনা করেন। তারপরও মেহেরপুরের বিষয়টি নিয়ে সামনের মিটিংএ আলোচনা করবো।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এর উপ মহাপরিচালক হসিবুজ্জামান বলেন, শিশু শ্রম নিরসন বা পুনর্বাসনের জন্য ইতিমধ্যে সরকার কাজ করছে। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকে। আমাদের মেহেরপুরে শিশু শ্রমের একটি তালিকা তৈরি করে তাদেরও সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবো।