মেহেরপুরে শহর ও গ্রামে সর্বত্রই চলছে রমরমা ক্রিকেট জুয়া। আগে কেবল শহর এলাকায় ক্রিকেট জুয়ার বাজি ধরতে দেখা গেলেও এখন তা মহামারির মতো প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এমনকি যারা নিরক্ষর তারাও বাজি ধরছেন আইপিএল, বিপিএল, টি-টয়েন্টি কিংবা যেকোনো ক্রিকেট খেলায়।
বর্তমানে চলছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল), যা জুয়াড়ীদের ভরা মৌসুম। প্রতিদিন হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরছেন জুয়াড়ীরা। ক্রিকেট জুয়ার নেশায় পড়ে টাকা হারিয়ে অনেকেই এখন সর্বশান্ত। এই জুয়ার বাজি হয় মোবাইলে। তাই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাই এক প্রকার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। খেলা শুরু হলেই টিভির সামনে দেখা যায় জুয়াড়ীদের আনাগোনা। তবে জুয়ার বিষয়টি সকলের নজরে আসায় জুয়ার সাথে সম্পৃক্ত ডিলার বা মিডিয়ারা বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করে বর্তমানে চালাচ্ছে জুয়ার আসর। খেলা শুরুর আগে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মিডিয়া অপরপ্রান্তে জুয়াড়ীরা ব্যস্ত হয় কোন দলের কত রেট তা জানতে। এই জুয়া বা বেটিং সাধারণত দুই দলের হার-জিতের ওপর ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে ভালো দল, যার জয়ের সুযোগ বেশি তার বাজির হার বড় আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল ছোট ।
পদ্ধতিটি যেমন, মনে করুন পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকা খেলা হচ্ছে। তখন পাকিস্তানের পক্ষে বাজি হলো ছোট এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে বড়। দক্ষিণ আফ্রিকা যেহেতু ভালো দল, তাই যে বাজি ধরবে সে ২০০০ দিলে ১০০০ টাকা পাবে। আর বাংলাদেশ যেহেতু দুর্বল দল তাই বাংলাদেশ জিতলে যে বাজি ধরবে সে ১০০০ দিলে ২০০০ পাবে। অর্থাৎ আপনি যদি অজিদের হয়ে বাজি ধরেন তবে আপনাকে কমপক্ষে ২০০০ টাকা দিয়ে বাজি ধরতে হবে। আর বাংলাদেশ ধরলে ১০০০ টাকা। যদিও এই বাজির টাকা প্রায়ই ওঠানামা করে। আবার খেলার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে দল পাল্টিয়েও নেওয়া যায় কখনও কখনও । এই বাজির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জুয়াড়ী দুর্বল দলের হয়ে বাজি ধরে থাকে। কেননা এতে বিনিয়োগ কম থাকে আর লাভ বেশি। অনুসন্ধানে জানা গেছে প্রতি রাতে সারা শহরজুড়ে চলে লক্ষ লক্ষ টাকার জুয়া। ক্রিকেট জুয়ার পুরো ব্যবস্থায় থাকেন কয়েকজন বড় ডিলার বা মিডিয়া। তারা দুই পক্ষের লোকজনের কাছে মোবাইলে অর্ডায় নেয়। জুয়ায় বিজয়ীদের ঠিকমতো টাকাও পরিশোধ করে তারা। দুই পক্ষের কমিশনের উপরে চলে এসব ডিলার বা মিডিয়ারা। এসব ডিলার বা মিডিয়ারা জুয়া পরিচালনা করে কেউ কেউ এখন লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছেন। এসকল ডিলার বা মিডিয়ারা শহরের বিভিন্ন স্থানে নামমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে কর্মচারীর মাধ্যমে জুয়ার টাকা লেনদেন করেন। মূল ডিলার বা মিডিয়ারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই জুয়া খেলে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেকেই। ঘটেছে আত্মহত্যার মতো ঘটনা। শুধুমাত্র ক্রিকেট-ই নয় মোবাইল অ্যাপস এর মাধ্যমেও মোবাইলে প্রকাশ্েযই বেটিং সাইটগুলোতে চলছে জুয়া। বেট-৩৬৫ ডটকম নামের সাইটটি সর্বক্ষণিক জুয়া খেলার অন্যতম মাধ্যম। এই সাইটের সকল খেলা জুয়ার জন্য। বৈদেশিক ডলারের মাধ্যমে এই সাইটের খেলাগুলো খেলে থাকে জুয়াড়ীরা। প্রথমে সাইটের শর্তনুযায়ী একাউন্ট করতে হয় এরপর একাউন্ট চালু হলে সেখানে ডলার ইনভেষ্ট করে খেলা করা যায়। যে কারণে এই খেলা চালাতে অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচাঁও করে অনেকেই ।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক জানান, আমার ছেলে ক্রিকেট জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছে। লাখ লাখ টাকা জুয়া খেলে উড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির আসবাপত্র, গহনা চুরি করে জুয়া খেলেছে। নিজের থাকার খাটটিও বিক্রি করে দিয়েছিল। এখন সব হারিয়ে সে বুঝতে পেরেছে। ওর জন্য মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। শুধু আমি না আমার মতো মেহেরপুরের অনেক পরিবারই সন্তানদের নিয়ে এমন কষ্টে আছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মেহেরপুরে ক্রিকেট জুয়ার অন্যতম ডিলার হিসেবে পরিচিত মেহেরপুর শহরের এশিয়া নেট মোড় এলাকার ‘ক’ অদ্যক্ষর এর একজন। তিনি মেহেরপুরে ক্রিকেটে জুয়ার জগতের অন্যতম গডফাদার। জুয়ার টাকায় তার রাজকীয় জীবনযাপন। শুধু আইপিএলই নয়, এমন কোন খেলা নেই, যে সেই খেলার গেম ‘ক’ করে না। সারা বছরই ‘ক’এর মিডিয়াগিরি চলে। ক্রিকেট মৌসুমে লক্ষ থেকে কোটি টাকা লেনদেন হয় ‘ক’ এর হাত দিয়ে। এছাড়া ‘ক’ এর মাধ্যমে যারা জুয়া খেলে তারা সকলে বড় বড় পার্টি। মোটা টাকার জুয়া খেলে এসব পার্টিরা। ‘ক’ এর কাছে এক গেমে লাখ টাকা বিট করার মতো পার্টিও আছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে শহরের মিমি বেকারি এলাকার ‘র’ অদ্যক্ষরের আরেক জুয়াড়ী। ‘ক’ ও ‘র’ প্রশাসনের বিভিন্ন সদস্যদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে দীর্ঘদিন ধরে জুয়ার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ক’ ও ‘র’ সাথে প্রশাসনের সদস্যদের ওঠাবসা সহ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেলিব্রেট করতে দেখা গেছে। প্রশাসনের সাথে সখ্যতা থাকার কারণে এসকল ডিলার বা মিডিয়ারা কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা জুয়ার ব্যবসা। কমিশনের টাকায় হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক।
এছাড়াও জুয়াড়ীদের মধ্যে নামের অদ্যক্ষর দিয়ে রয়েছে হোটেল বাজার এলাকার ‘ল’, পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড এলাকার ‘প্র’, ‘বি’, ‘লি’, ‘রি’, শেখ পাড়ার ‘রু’, হাই স্কুল পাড়ার ‘র’, হালদারপাড়ার ‘ও’, ঈদগাহ পাড়ার ‘ম’, মল্লিকপাড়ার রমেশ ক্লিনিক এলাকার ‘ই’, তাহের ক্লিনিক পাড়ার ‘শ’সহ যে কয়েকজন ডিলার বা মিডিয়া রয়েছে তাদের আটকানো না গেলে এই জুয়া বন্ধ হবে না।
জুয়ার নেশায় নগদ টাকা থেকে শুরু করে, বাড়ির আসবাবপত্র, পরিবারের সদস্যদের গহনা পর্যন্ত দিয়ে বাজি ধরছে অনেকেই। জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে তাদের পরিবারের লোকজনও পড়েছেন বিপাকে। অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে পরিবারে। অনেকেই হয়েছে ঋণগ্রস্থ। এখন জুয়া এক সামাজিক মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। নব্য এই জুয়া বন্ধ করা না গেলে শত শত পরিবারকে এর কঠিন মূল্য দিতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে মেহেরপুর সদর থানার ওসি শাহ দারা খান মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, আইপিএল শুরু হলেই এই চক্র বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। তাদের তথ্য প্রমাণসহ ধরাটাও বেশ জটিল। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।