মেহেরপুরের ভাটপাড়া গ্রামের মনোয়ারা বেগম। পেশায় একজন গৃহিনী। শীত আসলেই ভাপা পিঠা আর কলাইয়ের রুটি বিক্রি করেন। বছরের সব মাসেই টুকিটাকি বিক্রি হলেও শীতের সময় ভাপা পিঠা আর কলাই এর রুটির কদর বাড়ে।
খেজুর গুড় আর নারিকেল সাথে আউশ ধানের চাল বাটা। এই তিনের সমন্বয়ে তৈরী করা হয় ভাপা পিঠা। শীতের সকাল আর সন্ধ্যায় মনোয়ারার কাছে ভীড় জমায় পিঠা প্রেমীরা। কলাই রুটির কদরও কম নেই। মরিচ বাটা,বেগুন ভর্তার সাথে সরিষা বাটা, ধনিয়া পাতার ভর্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত বিক্রি করেন কলাই রুটি।
মনোয়ারার সংসারে এটি একটি আয়ের জন্য নতুন উৎস। তড়ি ঘড়ি ময়দা নারকেল আর হাড়ি পাতিল নিয়ে ছুটে চলেন বাজার কিংবা রাস্তার পাশে। তৈরী করেন ভাপা পিঠা।
গরম গরম মজাদার এ পিঠা খেতে দূর দূরান্ত থেকে চলে আসেন সব বয়সি নারী পুরুষ। গভীর রাত পর্যন্ত চলে বেচা কেনা। প্রতিদিন খরচ খরচা বাদে হাজার খানেক টাকা পকেটে আসে। প্রতি শীতকালে তার এ ব্যবসা চলে। মনোয়ারা নয়, তার মতো অনেকেই বিভিন্ন বাজার ঘাটে শীতের পিঠা বিক্রি করছেন। শীত আসলেই কদর বাড়ে ভাপা পিঠা আর কলাই রুটির।
বামন্দী বাজারের পিঠা বিক্রেতা সোহেল জানান, গত দেড় মাস যাবত তিনি পিঠা বিক্রি করছেন। সংসারের কাজ শেষে বাড়ির বউয়ের দেয়া সব সরঞ্জামাদি নিয়ে বসে পড়েন বাসস্ট্যান্ডে। কথা বলার সময় নেই তার। দুহাতে ময়দা মাখা আর খেজুরের গুড়ের সস । ভাপা পিঠা তৈরী করছেন আর ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেতারা। কার আগে কে নিবে তা নিয়ে চলে পাল্লা। প্রতিটি ভাপা পিঠা বিক্রি হয় ১০ টাকায়। আর কলাইয়ের রুটির দাম ২০ টাকা।
গাংনীর পিঠা বিক্রেতা আব্দুল মোমিন ও তেতুল মন্ডল জানান, গরমকালে রেজাউল চত্ত্বরে শরবত বিক্রি করতেন। এখন শীতকাল তাই পিঠা বিক্রি করছেন তিনি। প্রতিদিন অন্ততঃ দেড় হাজার টাকা আয় হয়। একই কথা জানালেন পিঠা বিক্রেতা রমজান আলী।
পিঠা খেতে আসা জুরাইস ইসলাম জানান, বাড়িতে সব সময় পিঠা তৈরী হয় না। তাছাড়া নারীরা এখন সংসারের কাজকর্ম ফেলে আগের মতো পিঠা তৈরী করে না। অনেকে আবার পিঠা তৈরী করতেও জানে না। তাই এখান থেকে পিঠা নিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের জন্য। অত্যন্ত সুস্বাদু এ পিঠা এবং ঘরোয়া পরিবেশে তৈরী বলে প্রশংসাও করেন তিনি। একই কথা জানান কলেজ শিক্ষার্থী তমা। পিঠা খেতে বান্ধবীদের সাথে এসেছেন তিনি। নিজেরা খেয়ে আবার বাড়ির লোকজনদের জন্যও নিয়েছেন তারা।
গাংনী মহিলা ডিগ্রী কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রমজান আলী জানান, শীতকালে পিঠা পুলির চাহিদা বেশ। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। শীতকালে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই নানা রকমের পিঠা পুলি তৈরী হতো। এখন আর আগের মতো নেই। সব কৃত্তিমতায় ভরা। শহরের সব ধরণের পিঠা পুলি বিক্রি হয়। ফলে আর কেউ ঘরোয়া ভাবে তৈরী করে না। তার পরও পথের ধারে যারা পিঠা বিক্রি করছেন তারা এ ঐতিহ্যটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। সেই সাথে পিঠা বিক্রি করে উপরি আয় করছেন অনেকেই।
মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাসিমা খাতুন জানান, দিন দিন অনেক পিঠাই আজ বিলুপ্তির পথে। অনেক বাড়িতেই হয়না আর কলাই রুটি। মনোয়ারাদের মত অনেক গৃহিনীরাই শীতকালে পিঠাপুলি বা কলাই রুটি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ এটা একটি মৌসুমী ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। অনেকেই বাড়িতে অনেক টাকা খরচ করে ভাপা পিঠা বা কলাইরুটি খেতে পারেননা। অথচ হাতের নাগালে থাকায় খুব সহজেই ১০ টাকা আর ২০ টাকায় কলাই রুটি আর ভাপা পিঠার স্বাদ পাচ্ছেন। তবে এটিকে বানিজ্যিক ভাবে ব্যাপকতা বাড়ালে অনেকেই আয়বৃদ্ধি করতে পারেন।