আল-আমিন, এম এফ রুপক:
পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য শেষ সম্বল টুকুও হারাতে হচ্ছে বিদেশ নামক সোনার হরিন ধরতে। কারও কারও ভাগ্যের চাকা ঘুরলেও নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। মেহেরপুরে লাইসেন্স বিহিন কথিত আদম ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন বিদেশগামীরা। সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে প্রাণও হারাচ্ছেন কেউ কেউ। নিঃস্ব হয়ে পরিবারের সদস্যরা ভাসছে অথৈই সাগরে।
মেহেরপুরের প্রায় প্রতিটির গ্রামেই রয়েছে কমিশন ভিত্তিক দালাল। মোটা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অবৈধ কোম্পানী, কর্মহীন ভুয়া কোম্পানীর ভিসা কিংবা যে কাজের কথা বলে বিদেশে পাঠানো হয় সে কাজ না দিয়ে অন্য কাজ দেওয়া ইত্যাদি নানা কারনে প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরছেন অনেকেই আবার কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে প্রবাসে। অর্থ উপার্জনের আশায় শুধু পুরুষরা না মহিলারাও যাচ্ছেন বিদেশে। সেখানে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন অনেকেই।
আদম দালালের খপ্পরে পড়ে কপাল পুড়েছে কদভানু নামের এক গৃহবধুর। বাড়ি মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাঁঝাঁ গ্রামে। স্বামীর নাম আনারুল ইসলাম। আবার পরিবারের কথা ভেবে নির্যাতন সহ্য করে টিকে আছে অনেকেই। এদের মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের হাসার আলীর স্ত্রী ঝর্না (ছদ্ব নাম)। রয়েছেন দুবাই।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর প্রক্রিয়াটা দালালনির্ভর। তবে তাদের দৌরাত্ম্য যে কতটা প্রকট, তা বেরিয়ে এসেছে এক গবেষণায়। এতে দেখা গেছে, ভিসা কেনাবেচা আর ধাপে ধাপে দালালদের কারণে ৩ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে বিদেশগামীদের। বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উল্টো সেখানেও ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ পেয়েছেন গবেষকেরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে যাওয়া বিদেশগামী পুরুষদের ৯০ শতাংশই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। আর ভিসা বা চাহিদাপত্র কিনতে শুধু ২০১৬ সালে ৫ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মেহেরপুরে ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছে ৭ হাজার ৮শ ৯জন।
কেউ কেউ সুখে থাকলেও অনেকেই হারিয়েছেন শেষ সম্বল টুকু। ভুক্তভোগীরা দেশে ফিরে ন্যায় বিচারের আশায় বিভিন্ন দারে দারে ঘুরে বিচার না পেয়ে হতাশায় ভুগছে অনেকেই। আবার অভিযোগের ভিত্তিতে কেউ কেউ আটক হচ্ছেন পুলিশের হাতে। মেহেরপুর প্রতিদিনের বিশেষ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এইসব আদম দালালের নাম। মেহেরপুরের গাংনী থেকে লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য আব্দুস সামাদ আজাদকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা। উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের ভোলাডাঙ্গা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রয়েছে সামাদ ধানখোলা ইউপির কসবা মোল্লাপাড়া এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে এবং ভোলাডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তার নামে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানায় মানব পাচারের অভিযোগে মামলা রয়েছে। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের পরে গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত ও আহত হন ১১ জন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সামাদ ওই চক্রের সক্রিয় সদস্য বলে স্বীকার করেন।
গাংনীর রামনগর গ্রামের খাইরুল ইসলাম। একই উপজেলার হাড়াভাঙ্গা পূর্বপাড়ার সৌদি প্রবাসী শাহাবুদ্দিনের স্ত্রীর কাছে ধাপে ধাপে ৯ লাখ টাকা দিয়ে সৌদতে যায় খাইরুল ইসলাম। বছর না যেতে তাকে দেশে ফেরত আসতে হয়। টাকা ফেরত চাইতে বেকে বসে শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী আসমা খাতুন। উপায় না পেয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেন খাইরুল।
মুজিবনগর উপজেলার ভবের পাড়া গ্রামের ফিরোজ। বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকেই নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রতারণার মামলা। একই উপজেলার বাগোয়ান গ্রামের আনোয়ার কোন রকম লাইসেন্স ছাড়াই চালাচ্ছে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ। সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের আমিরুল ইসলাম, তার ভাই মোমিনুল ইসলাম, একই কায়দায় চালাচ্ছে আদম দালালী। কমিশনের ভিত্তিতে এলাকায় থেকে লোক পাঠানোর কাজ করেন তারা।
গাংনীর আযান গ্রামের নিয়াজুল ইসলাম। দালালী করতে গিয়ে এক বছর জেলও খেটেছেন। লাইসেন্স বিহীন আদম দালালের তালিকায় রয়েছেন তেরাইল গ্রামের জাহাঙ্গীর, বামুন্দীর কাসেম, কাজীপুর গ্রামের আসমত, চেঙ্গাড়ার আব্দুর রাজ্জাক এলাকার প্রভাবশালী আদম দালাল। আরেক আদম ব্যবসায়ী গাংনী উপজেলার খড়মপুর গ্রামের আহম্মদ আলী এ উপজেলার খড়মপুর গ্রামের সাদাত আলীর ছেলে আসান আলী, একই গ্রামের জাকিরুল, ওয়াসিম, কসবা গ্রামের জিয়াউর, সানঘাটের সাইফুল, পাকুড়িয়ার রুস্তম, আড়পাড়ার মিনারুল ও মেহেরপুর সদরের আমদহ গ্রামের লালনকে একই রকমের ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের পর মালয়েশিয়া পাঠায়। তারা এখনও অবৈধভাবে মালয়েশিয়া অবস্থান করছে। চুরি করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
মেহেরপুরে যতারপুর গ্রামের মেহেদী হাসান ওরফে বিজন। ব্রুনাইয়ে মানব পাচার চক্রের প্রধান ব্যক্তি। মেহেদী ব্রুনাইয়ের এক নারীর সঙ্গে যৌথভাবে, কখনো এককভাবে একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পাচার করেন। সর্বশেষ ৪ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩৩ কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যায় মেহেদী। কিন্তু তাঁদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। ব্রুনাইয়ে রাস্তায় তাঁদের দিন কাটতে থাকে। পরে করোনা মহামারির সময় দেশে নিজ পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তাঁরা ব্রুনাইয়ে অবস্থানরত মেহেদী হাসানসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মানব পাচার ও প্রতারণার আইনে অন্তত ২০টি মামলা করেন। তাঁর কয়েকজন সহযোগী ধরা পড়লেও পুলিশ বলছে, মেহেদী হাসান ও তাঁর অন্য সহযোগীরা দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
গাংনী উপজেলার হিজল বাড়িয়া গ্রামের ইয়াছিন আলীর ছেলে নাহিদ। নাহিদ বিভিন্নভাবে এলাকার সাধারণ মানুষকে ফুসলিয়ে ভুয়া ভিসায় সৌদিতে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। তার প্রতারণার শিকারে অনেকেই সর্ব শান্ত হয়েছে জানা গেছে। এই নাহিদরে মাধ্যমেই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার ১৭ জন শ্রমিক সৌদিতে পাড়ি জমায়। প্রতারনার শিকার হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন পার করছিল তারা। এ নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিন এ সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশ এ্যাম্বাসির সহযোগীতায় দেশে ফেরে তারা। এ ছাড়াও দালালের খপ্পরে পড়ে ১০ লাখ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে গ্রীসে যাওয়ার পথে লাশ হতে হয়েছে ইব্রাহিম নামের একজনকে। মেহেরপুর সদর উপজেলার ইসলামনগর গ্রামের নুরুল আমিন এর ছেলে ইব্রাহিম।
মেহেরপুর পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলি জানান, প্রবাসে গিয়ে যারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তাদের সহযোগীতার জন্য আলাদাভাবে খোলা হয়েছে প্রবাসী কল্যান হেল্প ডেস্ক। এ ধরনের অভিযোগ আসলে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। যদি সমাধান না হয় তাহলে আদালতের দারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে প্রবাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে জনসাধারণকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন পুলিশ সুপার।