মেহেরপুরে তিব্র রাসায়নিক সার সংকট তৈরি হয়েছে। সার পেতে কৃষকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবে এই সার সংকট তৈরি হয়েছে অতিমাত্রার তামাক চাষ ও অত্যাধিক ডিএডপি সার ব্যবহারের কারণে বলে জানিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর ।
চলতি রবি মৌসুমে মেহেরপুরে ২৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে তামাক চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছরেও ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিলো। পরিবেশবান্ধব টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারে ভর্তুকি দেওয়া হলেও সেই সুবিধা নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়ায় তামাক চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০, টিএসপি ৫০, এমওপি ৬০ টাকা। ৫ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে এখন প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা ও এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রাধাগোবিন্দপুর ধলা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মোফাজ্জেল হোসেন । চলতি মৌসুমে তিনি ১১ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন। মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, “আমি দুটি তামাক কোম্পানির তালিকাভুক্ত চাষি। প্রতি বিঘা জমিতে তামাক চাষের জন্য কোম্পানি থেকে আমাদের শুধুমাত্র রাসায়নিক সার হিসাবে সালফেট অব পটাশ (এস ও পি) ও বাজার থেকে অন্যান্য সার কেনার জন্য নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। আমার ১১ বিঘা জমিতে ১১০ বস্তা ডিএপি, ২২ বস্তা এমপি, ২২ বস্তা ইউরিয়া, ১১ বস্তা সালফেট প্রয়োজন পড়বে।
একই এলাকার কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, আমার ৬ বিঘা জমিতে ফুল কপির চাষ করেছি। এই ৬ বিঘা জমিতে টিএসপি, ৬ বস্তা, ডিএপি ৬ বস্তা, এমপি ৩ বস্তা, ইউরিয়া ৩ বস্তা। কিন্তু চলতি মৌসুমে চাহিদা অনুযারী কোন সার পাওয়া যায়নি। সারের অভাবে ফুল কপি সময়মত বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এবারে বড় আকারের লোকশানে পড়তে হবে।
গত বছরে নভেম্বর মাসে ডিএপির মোট বরাদ্দ ছিলো ১ হাজার ৯৯৩ মেট্রিকটন। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৫১৭ মেট্রিকটন।
জানতে চাইলে বিসিআইসির ডিলার মিরাজুল হক বলেন, কৃষকেরা সবজি চাষের নামে তামাক চাষে ডিএপি ব্যবহার করছে। এই কারণে ডিএপি সারের সংকট দেখা দিয়েছে। সবজি চাষে তামাক চাষের মত অতিরিক্ত সারের প্রয়োজন পড়ে না। কোন কৃষক কোন ধরনের ফসলের চাষ করছেন তা জানার উপায় থাকে না।
একই এলাকার কৃষক ছাদের আলী । তিনি বলেন, “ডিএপি সার হলো তামাকের প্রাণ। এটি ব্যবহার না করলে তামাকের ভালো ফলন পাওয়া যায় না।” তামাক কোম্পানিগুলো এর আগে সব রকমের সার দিতো। বর্তমানে শুধু মাত্র এস ও পি সার সরবারহ করে। এমওপি, ডিএপি সার এলাকার ডিলারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বর্তমানে বিশেষ করে ডি এপি সারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। একজন কৃষককে ৫০ কেজির বেশি ডিএপি সার দেওয়া হচ্ছে না। সারের যোগান দিকে কৃষকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ সামছুল আলম বলেন, মেহেরপুরে তামাকের চাষ হচ্ছে দির্ঘদিন থেকে। সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে তামাক চাষে কৃষকদের অনুৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু তামাক কোম্পানির নানান সুবিধার জন্য কৃষকদের মধ্যে তামাক চাষ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে ডিএপি সারের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুন শুধুমাত্র তামাক চাষের কারণে।
সবজি,ধান,পাট, গম,পেঁয়াজ, রসুন, আলু চাষে নির্দিষ্ট পরিমানে সার ব্যবহার হয়। অন্যদিকে শুধুমাত্র তামাক চাষে বিঘা প্রতি ৫০০ কেজি ডিএপি সার ব্যবহারের প্রবনতা তৈরি হয়েছে কৃষকদের মাঝে। একারণে অন্যান্য ফসলের জন্য সার পাচ্ছেন না কৃষকেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিদেশি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, তামাক কোম্পানি কৃষকদের তামাক চাষে সুবিধবার জন্য এসওপি সার বিদেশ থেকে আমদানি করে সরবারহ করে। ডিএপি, এমওপি, ইউরিয়া, জিপসাম সার বাইরে থেকে কেনার জন্য নগদ টাকা দেওয়া হয় ।
সরকারি সার সুপারিশ নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে, এক বিঘা ফুল কপির জমিতে ২৯ কেজি ইউরিয়া, ৩৩ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে একই জমিতে যদি তামাক চাষ করা হয় সেখানে কৃষকেরা বিঘা প্রতি জমিতে শুধুমাত্র ডিএপি ৫০০ কেজি ব্যবহার করছেন। ইউরিয়া ৫০ কেজি, এমওপি ৫০ কেজি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ভর্তুকির সার চলে যাচ্ছে তামাক চাষে। অন্যান্য গুরুত্বপর্ণ ফষলের জন্য সার মিলছে না বাজারে। সরকারি ডিলারদের বরাদ্দের চেয়ে বেশি পরিমানে সারের প্রয়োজন পড়ছে শুধুমাত্র তামাক চাষের জন্য। কিন্তু সরকার তামাক চাষের জন্য কোন প্রকারের সারের বরাদ্দ দেয়না।
জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, মেহেরপুরে রবি মৌসুমে তামাক চাষের কারণে সার সংকট তৈরি হয়। তামাকে অধিকমাত্রায় সার ব্যবহারের কারণে সবজিসহ অন্যান্য ফসলের জন্য কৃষকদের সার পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সার সংকট তৈরি হবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মাসে বিএডিসি ও বিসিআইসি থেকে জেলাতে ইউরিয়া বরাদ্দ ছিলো ৩ হাজার ৯৬৪ মেট্রিকটন, টিএসপি ১ হাজার ৭৮১ মেট্রিকটন, ডিএপি ২ হাজার ৪৫২ মেট্রিকটন, এমওপি সার বরাদ্দ ছিলো ১ হাজার ৮২৪ মেট্রিকটন। চলতি মৌসুমে ভুট্টার চাষ হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে, গম ১ হাজার ৩৬৫ হেক্টর, বোরো ধান রয়েছে ১৯ হাজার ২৬৫ হেক্টর, পেঁয়াজ রয়েছে ৪ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, বিভিন্ন সবজি ৩ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ ছলছে। যা গত বছরে ছিলো ২৬ হাজার হেক্টর।
সদর উপজেলার শোলমারি গ্রামের বাসিন্দা প্রান্তিক কৃষত হাসেম মিয়া বলেন, আমাদের এই এলাকায় সবজি চাষ বেশি হয়ে থাকে। ঠিক এই সময়ে এসে তিব্র সারের সংকট দেখা গেছে। আমার ৫ বিঘা ফুল কপি আর বাধাকপি রয়েছে। সারের সংকটে এখনো চাহিদা মোতাবেক সার সংগ্রহ করতে পারিনি। যদিও এলাকার কয়েকটি দোকানে বেশি দামে সার পাওয়া যাচ্ছে।
একই এলাকার বাসিন্দা কৃষক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ডিলারের দোকানে গেলে বলে সার নেই। এলাকার দোকানে ১ হাজার ৫০ টাকার ডিএপি সার ১ হাজার ৫০০ টাকা দামে কিনতে হচ্ছে। গত ১৬ বছর ধরে একই রকম দামে আমাদের সার কিনতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সারাফাত হোসেন বলেন, “এলাকায় খুচরা পর্যায়ে সার পাওয়া যায়। তবে ফসফেট, পটাশ, ড্যাপের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেশি পড়ে। চলতি মৌসুমে দাম বেশি দিয়ে ও সার পাওয়া যাচ্ছে না”।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, “কৃষি কর্মকর্তারা কখনোই তামাক চাষে কৃষকদের পরামর্শ দেন না। বরং তামাক চাষ থেকে কৃষকদের বের করে আনার পরামর্শ দেন। প্রতি বিঘা জমিতে তামাক চাষে কী পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে সেই পরামর্শ তামাক কোম্পানির কৃষিবিদরা দিয়ে থাকেন।” তামাক চাষের কারণে সবজি সহ অন্যান্য ফসলের সার পেতে কৃষকদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছ “।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরে উপপরিচালক বিজয় কৃঞ্চ হালদার বলেন, “ তামাক চাষ কৃষি জমি ও পরিবেশের জন্য মারাত্তক হুমকি। তামাক চাষে কৃষকদের নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।