মেহেরপুরে লিচু বাগান জুড়ে থোকায় থোকায় ঝুলছে গাড় লাল ও গোলাপি রংয়ের লিচু। সুস্বাদু ও রসালো এবং শাঁসে ভরপুর। প্রচন্ড তাপদাহ সহ্য করেও লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে চলতি মৌসুমে লিচু চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা। লিচু আবাদ লাভজনক হওয়ায় চাষে ঝুঁকে পড়া কৃষকরা বলছেন,দেশের বাজারেই নয়,বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হলে লিচু আবাদে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তবে রপ্তানিমুখি করতে কৃষি বিভাগকে আন্তরিক হওয়ার দাবী কৃষকদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন মেহেরপুরের লিচুর পরিচয় পেলে পাওয়া যায় বেশি দাম এবং বাড়ে ক্রেতাদের চাহিদা । চলতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৩২ কোটি টাকার লিচু উৎপাদনের সম্ভাবনা নিয়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কুষি বিভাগ।
মেহেরপুর জেলা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য লিচুবাগান। জেলায় এবার ৬৯০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করেও চলতি মৌসুমে প্রায় ৪০০০ মেট্রিকটন লিচু উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। যা জেলার মানুষের চাহিদা পুরুনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় কদরে বিক্রি হচ্ছে মেহেরপুরের লিচু। বর্তমানে বাগানে বাগানে এবং হাটে বাজাওে চলছে লিচু ভাঙ্গা ও বেচা কেনার মহাউৎসব।
আম-কাঁঠালের পাশাপাশি জেলায় লিচুর চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। ভৌগলিক কারণে মেহেরপুরে আগাম জাতের লিচু চাষ হয়। দাম ভালো থাকায় জেলায় দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে লিচুর চাষ। তবে এবছর তেমন ঝড়ঝাপটা না থাকায় সব গাছেই লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। অতিমাত্রায় তাপপ্রবাহের কারনে অনেক গাছের লিচুর খোঁষা ফেটে শুকিয়ে যাচ্ছে । অনেকেই খোঁষা ফেটে যাওয়া ঠেকাতে লিচু গাছে নিয়মিত সেচ দিচ্ছেন এবং লিচুতে পানি স্প্রে করছেন।
এবছর জেলায় দেশী ও আটি মোজাফ্ফর,বোম্বাই,আতা বোম্বাই ও চাইনা -৩ জাতের লিচুর চাষ হয়েছে। বাজারে উঠতে শুরু করেছে মোজাফ্ফর ও বোম্বাই জাতের লিচু। চাইনা -৩ জাতের লিচু বাজারে আসতে আরও দুএক সপ্তাহ সময় লাগবে।
মেহেররপুর সদর উপজেলার ঝাওবাড়িয়া গ্রামের লিচু চাষি আব্দুর রহিম জানান, নিজের ৫ বিঘা জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। পরিবারের চাহিদা পুরুনের পাশাপাশি আত্নীয় স্বজনদের লিচু দিয়ে থাকেন।অবশিষ্ঠ লিচু অন্যান্য বছর পাইকারি বিক্রি করলেও এবছর তিনি নিজেই খুচরা বাজারে বিক্রি করছেন। এক পন (৮০টি) লিচু বিক্রি করছেন ১৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকায়। অর্থাৎ ১০০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকায়।
ভিন্ন দেশে থেকে যেমন বিভিন্ন ফল আমদানি করা হয়,তেমনি ভাবে আমাদের মেহেরপুরের ফল লিচু সরকারি ভাবে বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ তৈরীর দাবী জানান এই বাগান মালিক। ভাল ফলন ও দামে অনেক খুশি বাগান মালিক আব্দুর রহিম।
মেহেরপুর পৌর কলেজ পাড়ার আরেক চাষি মো; উজ্জল হোসেন জানান, তিনবিঘা জমিতে লিচুর বাগান করেছেন। এক সপ্তাহ ধরে তিনি লিচু বিক্রি শুরু করেছেন। লিচু শেষ হলে তিনি লাভ লোকসান ভুঝবেন। তবে তিনি এবছর খরচ বাদ দিয়ে দুই লাখ টাকা লাভের আশা করছেন।
সদর উপজেলার ঝাওবাড়িয়া গ্রামের লিচু বাগান মালিক আব্দুল হান্নান জানান, তার তিন বিঘা জমিতে লিচুর বাগান করেছেন। উক্ত বাগানের লিচু পাকা শূরুর আগেই পাইকারি বিক্রি করেছেন। এবছর তিনি আড়াই লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছেন। তিনি আরও জানান, আমাদের মেহেরপুরের আম বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আমের পাশাপাশি যদি লিচু বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয় তাহলে চাষিরা আরও লাভবান হবে।
গাংনীর সাহারবাটি গ্রামের বাগান মালিক গোলাম ফারুক জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে লিচুর বাগান করেছেন। এবছর প্রচুর লিচু হয়েছিল তার বাগানে। তিনি পেশায় একজন সরকারি চাকুরিজীবী তাই খুচরা বিক্রি সম্ভব হয়নি। একরকম বাধ্য হয়েই পাইকারি বিক্রি করতে হয়েছে লিচু। দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন তার লিচু বাগান। সরকারের কাছে তিনি দাবী রেখে জানান, আমাদের দেশের মানুষের কাছে বিদেশি ফলের অনেক কদর রয়েছে। বিদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক টাকার ফল আমদানি করা হয়। অথচ আমাদের দেশি ফল লিচু অনেক সু-স্বাদু। বিশেষ করে মেহেরপুরে উৎপাদিত ফল ফলালি দেশের বিভিন্ন জেলায় খ্যাতি অর্জন করেছে। বিদেশেও মেহেরপুরের আমের পাশাপাশি লিচুর খ্যাতি বয়ে আনতে চাই। সেজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
লিচু সংগ্রহে নিয়োজিত শ্রমিক আব্দুল আজিজ ,চাঁদমিয়া ও গোলাম রব্বানি জানান, প্রায় এক মাস ধরে আমরা লিচুর বাগান পরিচর্যা করে আসছি। এখন লিচু সংগহ কাজে নিয়োজিত। প্রতিদিন আমাদের ৬০০ টাকা করে মজুরি দিয়ে থঅকেন বাগান মালিকরা। আমাদের একাজ চলবে আষাঢ় মাসের শেষ পর্যন্ত। শুধু আমরাই নয়, জেলার বিভিন্ন লিচু বাগানে কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হচ্ছে। আমাদের সাথে অনেকে রয়েছে যারা কলেজে লেখা পড়ার পাশাপাশি লিচুর বাগানে কাজ করে আর্থিক উপার্জনে পরিবারকে সহায়তা করছে।
বরিশাল জেলা থেকে মেহেরপুরে লিচুর পাইকারি ক্রেতা মানিক মল্লিক জানান, প্রায় প্রতি বছরই মেহেরপুরের লিচুর পাইকারি ব্যবসা করি। মেহেরপুরের লিচু দেশের বরিশাল,ভোলা,বরগুনা, চ্পাাইনবাবগঞ্জ,খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করি। যখনই ক্রেতারা জানতে পারে আড়তে মেহেরপুরের লিচু এসেছে তখনই দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। অনেকেই আমাকে অগ্রীম টাকা দিয়ে থাকেন মেহেরপুরের লিচ কেনার জন্য। ব্যবসা শুরু থেকে মেহেরপুরের লিচু আমাকে লাভের মুখ দেখিয়েছে।
মেহেরপুরের লিচু দেখতে সুন্দর ও খেতেও সুস্বাদু তাই ব্যবসা করে প্রশান্তি আসে। অর্থ নৈতিকভাবে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে মেহেরপুরের লিচু আবাদে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার জানান, মেহেরপুরে ৮০ ভাগ বাগানে আটি লিচু চাষ হয়। এ লিচুর বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে- আটি মোজাফ্ফর জাতের লিচু আগাম পাকে। সংখ্যায় বেশি ধরে। পোকার আক্রমণ কম হয়। ফলের ৭০ ভাগই রসালো।এছাড়াও চায়না-৩ জাতের লিচু অনেক মোটা হয় । বর্তমান বাজারেও এর দাম বেশি। তবে এ লিচু পাকতে একটু সময় বেশি লাগে।
জেলায় এ বছর ৬৯০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৪শ মেট্রিকটন লিচু উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৩২ কোটি টাকা। লিচুর মুকুল হওয়ার সময় থেকে এপর্যন্ত চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছি। বৈরী আবহাওয়াতেও মেহেরপুর জেলায় লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। দামও ভাল পাচ্ছে বাগান মালিকরা। তবে মেহেরপুরের আমের যেমন খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ বিদেশে তেমনি ভাবে লিচুর খ্যাতি রয়েছে। আগামেিত আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগযোগ করে লিচু রপ্তানির ব্যবস্থা করা চেষ্টা করা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।