“জাল যার জলা তার, মৎস্যজীবীর অধিকার” বঙ্গবন্ধুর দেওয়া এই স্লোগান এখন “ক্ষমতা যার, জলা তার” এ পরিণত হয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার তেরঘরিয়া বীলটি এখন সেই ক্ষমতাবান অমৎস্যজীবীদের দখলে। সমিতির মুল সদস্যরা প্রতি ঈদে ২ হাজার করে টাকা পাওয়া ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পাননা। মুল ইজারার বিপরীতে সমিতির বাইরের ব্যবসায়ী এবং সমবায় অফিসের কয়েকজন চাকুরীজীবির নেতৃত্বে তেরঘরিয়া বিলে মৎস্য চাষ ও আয় ব্যায়ের সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যা সমবায় নীতির বিরোধী।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সূত্রোক্ত স্বারক মোতাবেক মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের তেরঘরিয়া বিল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাংলা ১৪২৬ হতে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত ৬ বছর মেয়াদে প্রথম চার বছর (বাংলা ১৪২৬, ১৪২৭, ১৪২৮ ও ১৪২৯ সন) বার্ষিক ২,৪০,৫০০ (দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার পাঁচ শ) টাকা এবং পরবর্তি ২ বছর (বাংলা ১৪৩০ ও ১৪৩১ সন) উক্ত অংকের ২৫ শতাংশ বর্ধিত ইজারামূল্যে তেরঘরিয়া ঈদগাহ পাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি: এর অনুকুলে ইজারা প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
জেলা প্রশাসক মেহেরপুরের পক্ষে উক্ত জলমহালটি উল্লেখিত সমিতির অনুকুলে বাংলা ১৪২৬ হতে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত ছয় বছর মেয়াদে উন্নয়ন প্রকল্পে ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর ২ লক্ষ ৪০ হাজার ৫শ টাকা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ আয়কর ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করায় শর্ত সাপেক্ষে বিগত ৮/৫/২০১৯ তারিখে জলমহালটি দখল হস্তান্তর করা হয়।
জলমহাল হস্তান্তর নীতিমালার ২ নং শর্তে উল্লেখ আছে, ইজারা গ্রহীতা জলমহালের পরিসীমা বজায় রাখবেন ও সংরক্ষণ করবেন। কেউ যাতে জলমহাল বেদখল না করে সেটি ইজারা গ্রহীতা নিশ্চিত করবেন।
তিন নং শর্তে উল্লেখ আছে, ইজারা গ্রহীতা জলমহালটি অন্য কাউকে সাব লীজ দিতে পারবেনা। সাব লীজ দিলে মূল ইজারা তৎক্ষণাৎ বাতিল বলে গণ্য হবে।
তিন নং শর্ত অনুযায়ী জলমহাল হস্তান্তর যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও বিলটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে জলমহালের একটি হস্তান্তর চুক্তিনামা সম্পাদিত হয় ১০ জনের নামে।
মধ্যসত্তাভোগী হিসেবে এই চুক্তির মালিকরা হলেন, মেহেরপুর শহরের ব্যবসায়ী নুর আলম, সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (তানিম), সমিতির সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসাইনের স্ত্রী মোছা: শাহানা আক্তার, মেয়ে আফসানা হাবিব, একটি বাড়ি একটি খামারের চাকুরিজীবী রফিকুল ইসলাম, তেঘরিয়া গ্রামের মিয়ারুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা সমবায় অফিসের সহকারী পরিদর্শক মো: শাহিনুজ্জামান, তার ভাই কামরুজ্জামান, মেহেরপুর সদর উপজেলা সমবায় অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ভূলেন্দ্রনাথ মৈত্রের স্ত্রী শিপ্রা মৈত্র ও সদর উপজেলার খন্দকারপাড়া গ্রামের দবির উদ্দীনের ছেলে তরিকুল ইসলাম।
তেরঘরিয়া বিলটি অবৈধভাবে সাব লীজে উল্লেখিত শর্ত দেওয়া হয়েছে, মৎস্য চাষে যে খরচ হবে, সমুদয় খরচ বাদে লভ্যাংশের ১ শ শতাংশের মধ্যে সমিতির সদস্যরা পাবে মাত্র ত্রিশ শতাংশ।
শর্তে আরো উল্লেখ আছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে মৎস্য চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে সমিতির সদস্যরা সেখানে মানবিক বিবেচনা দেখাবেন।
বিনিয়োগকারীরা লভ্যংশের ৭০ ভাগ ভোগ করলেও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে লোকসান হলে সেই লোকসানের দায়ভার বহন কেেরত বলা হয়েছে ৩০ ভাগ লভ্যংশ ভোগকারী সমিতির সদস্যদের উপর।
তেরঘরিয়া বিলের সাবেক সভাপতি তুহিন উদ্দীন (২০১৬-২০১৮) বলেন, আমাকে জোর করে সমিতি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সমবায় অফিসের ভূলেন্দ্রনাথসহ কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে চারজন সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি মৎস্যজীবীদের স্বার্থসংরক্ষণের কথা বলতে গেলে তাদের ভাল লাগেনা। বর্তমানে সমিতির ৪১ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৩ জন সদস্য মখলেছুর রহমান, মতিন আলী ও শওকত আলী সমবায় অফিসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে সুবিধা নিচ্ছেন। মাছ ধরার সময়ও সমিতির সদস্যদের না নিয়ে অন্যদের দিয়ে মাছ ধরছেন।
সাব লীজ প্রসঙ্গে, তেরঘরিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সম্পাদক আফজাল হোসাইন বলেন, সমিতির গচ্ছিত কোনো পুঁজি নেই। সেই হিসেবে চাষে বিনিয়োগের জন্য ভূলেন্দ্র নাথ মৈত্র আমাদের সাব লীজ সম্পাদনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। সাব লীজ দিলেও সমিতির সভাপতি ও সম্পাদককে সব বিষয়ে তদারকি করার কথা। কিন্তু সমবায় অফিসের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সমিতির সদস্যদের এসবের বাইরে রাখা হচ্ছে। এই সমিতির কোনো আয় ব্যায় হিসাব নিকাশ সম্পাদক হিসেবে আমাকে জানানো হয়না।
তিনি আরও বলেন, ২০২০/২১ সনের অডিট নোট পাওয়ার জন্য অনুরোধ করে জেলা সমবায় অফিসারের বরাবর চিঠি দিয়েছি আমি। কিন্তু জেলা সমবায় অফিসার প্রভাস চন্দ্র বালা আমাকে সেই অডিট নোট দিতে চাননি। এছাড়া নতুন করে অডিট অফিসার নিয়োগের আবেদন করলেও সেটিও দিতে অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে অপদস্ত করেন বলে অভিযোগ করেন। সমিতির আয় ব্যায়ের সকল হিসাব নিকাশ ও নথিপত্র সম্পাদকের কাছে থাকার নিয়ম থাকলেও সেটি রাখা হয়েছে ভূলেন্দ্র নাথ মৈত্র ও সভাপতির চাচাত ভাই শওকত আলীর কাছে।
জেলা সমবায় অফিসারের নির্দেশেই ভূলেন্দ্র নাথ মৈত্র ও মুজিবনগর সমবায় অফিসের সহকারী পরিদর্শক শাহিনুজ্জামান নিয়ন্ত্রণ করেন।
মাছ চাষের হিসাবটি এমন এক টাকা খরচ করলে এক টাকা লাভ হওয়ার কথা। অথচ সেখানে প্রতি বছর লোকসান দেখানো হয়ে থাকে। ১০৩ একরের তেরঘরিয়া বিলটিতে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা লাভ হলেও সেখানে প্রতি বছরই লোকসান দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।সমিতির সাধারণ একজন সদস্য শওকত আলী। সে সমিতির সভাপতির চাচাত ভাই। ভূলেন্দ্রনাথ মৈত্র সাধারণ সম্পাদককে বাদ দিয়ে শওকত আলীকে নিয়ে সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকেন।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগাঠনিক সম্পাদক গুরুদাস হালদার বলেন, মেহেরপুর জেলাতে ১০টি জলমহাল রয়েছে। সবকটিই এখন মধ্যস্বত্বাভোগীদের দখলে। তেরঘরিয়া বিলেরও একই অবস্থা। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা জলমহাল থেকে উপকার পাচ্ছেন না। ১০৩ একরের এই বিলটিতে ঠিকমত চাষ করতে পারলে ২০০ মৎস্যজীবী পরিবার (৫ সদস্য বিশিষ্ট) সারা বছরই খুব ভালভাবে জীবনাতিপাত করতে পারেন। মৎস্যজীবীদের কথা বিবেচনা করে জলমহালগুলো ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। জাল যার জল তার মৎস্যজীবীদের এই অধিকার পদে পদে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র বালা বলেন, মুল চুক্তি অনুযায়ী সাব লীজ দেওয়া সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। সাব লীজ হয়ে থাকলে ৩ নং শর্ত অনুযায়ী সেদিন থেকেই এই চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। অফিসের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা এই সাব লীজের সাথে কেনো জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি তাদের কাছে থেকে লিখিত জবাব চাইবো।