মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা।’ সেকথা মনে-প্রাণে ধারণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিন করেন। সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই দেশের পট পরিবর্তিত হয়। এরপর একে একে অনেকগুলি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালের বর্তমান শিক্ষানীতিতে দক্ষতা, মূল্যবোধও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে বিশেষভাবে জোর দিয়ে বাস্তবায়ন চলছে।
বর্তমান সদাশয় সরকারের আমলে প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে গমন,বিনামূল্যে বই বিতরণ, নারী শিক্ষায় অর্জিত অগ্রগতিতে উপবৃত্তি ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের অনুপাত বেশি। নারী শিক্ষার হার উচ্চশিক্ষায়ও বাড়ছে, বর্তমানে ৪০ শতাংশের মতো ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এর একটি রূপরেখাও তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নেবর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা উপযোগী নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের ছাত্ররা যতটা না শিক্ষাথী তার চেয়ে বেশিপরীক্ষাথী। নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে বির্তক চলছে। আমাদের শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। যুগের সাথে তালও মেলাতে পারিনি। বহুল আলোচিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণও করতে পারিনি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটা কী? সেটা বুঝাতে গিয়ে টম গুডউইন বলেছেন,“বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই”। অথচ সারা বিশ্বে তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অপরিসীম।বর্তমানে ভার্চুয়াল জগত এবং ভৌত জগতমিলে এবং তাদের মিথষ্ক্রিয়ায় এক অমিয় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে।
বর্তমানে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন ও দ্রুত পরিবর্তনের সক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে নিম্নোক্ত কথাটি স্মরণ করা যেতে পারে।
“পাঁচ কোটি লোকের কাছে রেডিওর পৌঁছাতে লেগেছে ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। অথচ ইন্টারনেটের লেগেছে ৪ বছর। আইপডের জন্য সময়টা মাত্র ৩ বছর আর ফেসবুকের? ২৪ মাস”। ‘কোডাক’ ক্যামেরা, মার্ফি রেডিও, এইচ এম টি ঘড়ি, এ্যাম্বাসেডর গাড়ি, প্রভৃতির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। একসময় দাপটের সাথেই এরা রাজত্ব করেছে। গুনে-মানে ভাল হলেও বছর বিশেকের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কারণ প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন এক স্মার্ট ফোন দিয়েই দশ ডিভাইসের কাজ সারছে।
এই পরিবর্তন আর সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে উপযুক্ত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা দরকার। কর্মবাজারের কথাই ধরা যাক। পি ডব্লিউ সি নামের একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিকসের পাল্লায় ২০৩০ সালে বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরিই নাই হয়ে যাবে। স্বভাবতই আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। অন্যদিকে নতুন ১০০ কোটি কর্মসৃজন হবে, তবে সেগুলো কেমন, তার বেশির ভাগই আমরা কল্পনা করতে পারছি না। মাত্র এক দশক আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লোককে ‘ফেসবুকে নজর রাখা’র জন্য চাকরি দেওয়া হবে।
আমাদের চলমান ব্যবস্থায় ২০৩০ সালে আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করব, সমাজে যাদের কোনো চাহিদাই থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে; সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে; শিক্ষাকে করতে হবে অ্যাকটিভিটিনির্ভর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
এই প্রেক্ষিতে মেহেরপুরের শিক্ষার সামগ্রিক অবস্থা কী এবং আমরা কতটুকু প্রস্তুত তা বোঝার জন্য শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল এখানকার গণমানুষ এখনও শিল্প কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকরী-বাকরীর প্রতি অনুরাগী হতে পারেনি, মানসিকতার বদল হয়নি। এখানে বিদেশযাত্রা নিয়ে তরুন যুবকরা যতটা আগ্রহী ততটা শিক্ষা নিয়ে নয়। যে কারণে মেহেরপুর জেলায় শিক্ষার হার মাত্র ৬৬.৭% (২০২২ এর আদমশুমারী অনুযায়ী)।
সরজমিনে পরিদর্শন ও খোঁজ খবর নিয়ে মেহেরপুরের শিক্ষাচিত্র পর্যালোচনা করলে যে বিষয়গুলি দৃষ্টিগোচর হয় তাহলো:
১. জেলার ৫০০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা এবং ১৩টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবকটির উন্নয়ন হয়েছে। আধুনিক, উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়েছে যা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দৃশ্যমান। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, পাঠদান পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।
২. ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি প্রযুক্ত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ-সবই এখন অনলাইনে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরূম ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।মেহেরপুরে ইতিমধ্যে প্রায় ৬০% প্রতিষ্ঠানে এই ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ৭০% প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১০০% বিদ্যালয়ে পাঠাগার এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার স্থাপিত হয়েছে।
৩. মেহেরপুরে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দ্রুত কমছে। বিজ্ঞানের প্রতি এই অনাগ্রহ গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজগুলোতে আরও বেশি প্রকট। দু’বছরআগে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে প্রায় ২২ শতাংশ ও উচ্চ-মাধ্যমিকে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়ছে।গত বছর যশোর বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছে মাত্র ২০.৭২%, এইচএসসি পরীক্ষায় ১৪.৮%। দেশে প্রযুক্তি শিক্ষার হার ১৫%। মেহেরপুরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
৪. ইউনেসকোর মতে, মানসম্পন্ন শিক্ষা মূলত যে তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে- তার প্রথমটি হচ্ছে শিক্ষক। সারা দেশের ন্যায় মেহেরপুরেও দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। পাঠদান, প্রশ্নপ্রণয়নওপরীক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রেশিক্ষকদেরইসৃজনশীলতারঅভাবরয়েছে।ফলে শিক্ষার গুণগত মান আশানুরূপ বৃদ্ধি হয়নি।
৫. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার অভাবে শিক্ষার্থীদের প্রকৃতপক্ষে মানসিক বিকাশ ঘটে না। একজন ছাত্রের পরিপূর্ণ বিকাশে যে সকল সহপাঠ্যক্রমের সুযোগ ও সুবিধা থাকা উচিৎ তা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপ্রতুল।মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গী ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আরও বৃদ্ধি করা উচিত।
৬. শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ ও অভিভাবকের ভূমিকা খূবইগুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে স্থানীয় সুশীল-শিক্ষিত মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে মেহেরপুর জেলার অনেক বিদ্যালয়ে এখনও প্রধান শিক্ষকের ব্যবস্থাপনায় এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটি গঠনে অনিয়ম, দুর্নীতি আছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নজরদারী বাড়াতে হবে।
৭. জেলায় চারটি সরকারী স্নাতক পর্যায়ের কলেজ ও ৩টি সরকারি টেকনিক্যাল কলেজ আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রায়শ: শিক্ষক স্বল্পতায়পাঠদানে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। প্রস্তাবিত মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গণমানুষের মধ্যে বিপুল আশা-আকাঙ্খার সৃষ্টি হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
৮. এনটিআরসি’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি কমে গেছে। তবে মেধাবী শিক্ষাথীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতাভিত্তিক বেতন প্রদান ও আর্থিক পুরষ্কার প্রদানের মত উন্নত ব্যবস্থা সুফল বয়ে আনতে পারে।
৯. মেহেরপুর জেলায় সরকারি ও বেসরকারী মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ১৫১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী। মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলায় টেকনিক্যাল কলেজ ও জেলা সদরে টিটিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার এবং ছহিউদ্দীন টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।ফলে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলায় মন্ত্রী থাকায় অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।তরুন শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভর করছে আমাদের আগামী দিনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। এদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে বদলে যাবে মেহেরপুর। সেক্ষেত্রে কারিগরী শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করতে হবে।
আজ আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিক্ষানীতি-২০১০ এর পূর্ণ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।
তথ্য সূত্র:
১. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোর
২. জেলা শিক্ষা অফিস, মেহেরপুর
৩. মুনীর হাসান: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব।
লেখক: প্রফেসর হাসানুজ্জামান (মালেক), সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, মেহেরপুর জেলা শাখা।